আমার সোনার বাংলা
বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত | |
কথা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০৫ |
---|---|
সঙ্গীত | গগন হরকরা, ১৮৮৯ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সুরারোপিত; ১৯০৫) |
গ্রহণকাল | ৩ মার্চ ১৯৭১ |
পূর্বসূরি | পাকিস্তান জিন্দাবাদ |
অডিও নমুনা | |
আমার সোনার বাংলা (কণ্ঠসঙ্গীত) |
বাংলাদেশ-এর সঙ্গীত | ||||||
ধরন | ||||||
---|---|---|---|---|---|---|
সুনির্দিষ্ট প্রকার | ||||||
|
||||||
মাধ্যম ও পরিবেশন | ||||||
|
||||||
জাতীয়তাবাদী ও দেশাত্মবোধক গান | ||||||
|
||||||
আঞ্চলিক সঙ্গীত | ||||||
|
||||||
আমার সোনার বাংলা হলো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বঙ্গমাতা সম্পর্কে এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ১৯০৫ সালে রচিত হয়। বাউল গায়ক গগন হরকরার গান "আমি কোথায় পাব তারে" থেকে এই গানের সুর ও সঙ্গীত উদ্ভূত।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি রচিত হয়েছিলো। ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বাউল” নামক গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত আছে।
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]সোনা শব্দটির অর্থ "স্বর্ণ" এবং সোনার শব্দটির আক্ষরিক অর্থ "স্বর্ণের অন্তর্গত" বা "স্বর্ণ দিয়ে তৈরি" এবং "আর" দখল করে। এটি "প্রিয়" অর্থপ্রিয় পরিভাষা হিসাবে ব্যবহৃত কিন্তু গানের মধ্যে সোনার বাংলা শব্দটি বাঙালির মূল্যবোধ প্রকাশ করতে পারে বা ফসল তোলার আগে ধানক্ষেতের রঙের তুলনা বোঝানো হয়েছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিলো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না।[১] সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিলো। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হয়। এই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি মুদ্রিত হয়েছিলো। তবে ৭ আগস্ট উক্ত সভায় এই গানটি গীত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।[১] বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, আমার সোনার বাংলা ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে অবস্থা ও ব্যবস্থা প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথম গীত হয়েছিলো।[১]
ডাকপিয়ন গগন হরকরা রচিত আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে গানটির সুরের অণুষঙ্গে আমার সোনার বাংলা গানটি তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত বঙ্গের নদীয়া জেলার শিলাইদহে রচিত হয়েছিলো।[১] সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তার শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিলো।[১] ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে পূর্ববঙ্গের বাউলদের ভিডমিড ও ভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ইতঃপূর্বেই পরিচয় হয়েছিল। ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে বঙ্গের পূর্বদিকে বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় দেশীয় লোকজ সুরের সঙ্গে তার আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলো, বিশেষত আমার সোনার বাংলা।[২] ১৯০৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর “বাউল” নামক গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৩]
জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অনুমোদন
[সম্পাদনা]১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে যোগ দেয় যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। তৎকালীন সময়ে রবীন্দ্রচর্চা একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল।[৪] ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আবদুল লতিফের সুর দেওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ছাড়াও ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি পরিবেশন করে। এরকম গান গাওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ উদ্যোক্তা ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। এরপর ১৯৫৩-৫৪ সালের ডাকসুর অভিষেক অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়া হয়।[২] ১৯৫৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু গণপরিষদ সদস্যদের সম্মানে গণপরিষদ সদস্য, পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও কাজী নজরুল ইসলামের গানের পাশাপাশি লোকগান পরিবেশন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীতজ্ঞ সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য অনুরোধ করেন। সনজীদার মতে পাকিস্তানিদের কাছে গানটির প্রতি প্রীতি ও ভালোবাসার জানান দিতে এবং গানটি বাঙালিকে কতখানি আবেগ তাড়িত করে তা বোঝাবার জন্যে অতিথিদের গানটি তিনি শোনাতে চেয়েছিলেন।[২][৫]
১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বলেন, "আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাহিবই, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হইবেই"।[৬] বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শাসকদের বিরুদ্ধে যেকোনো আন্দোলন ও প্রতিবাদে সাংস্কৃতিক কর্ম হিসেবে গানটি ব্যবহার করত। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সনজীদা খাতুন বলেন যে বিভিন্ন আন্দোলনে গাইতে গাইতেই গানটি জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল খানের মতে গানটির যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠাই ছিল ১৯৬৭ সালের আন্দোলনের সবচেয়ে স্থায়ী ফসল।[২][৭]
৩ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত এক জনসভায় গানটি গাওয়া হয়।[৮] একই দিন রাতে শেখ মুজিবুর রহমান তার জামাতা ও তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে "আমার সোনার বাংলা" গানকে গ্রহণ করার উপদেশ দেন।[৯] ১ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার দুই দিন পরে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এর জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ শুরু হওয়ার আগেও গানটি গাওয়া হয়। ২৩ মার্চে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা কুচকাওয়াজে গানটি গাওয়া হয়।[৮] ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মুজিবনগরে এই গান জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রথম গাওয়া হয়।[১০] যুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো। সেই সময় গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায়।[৮] ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা বিবেচনা করে এই গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।[১১] ১৯৭৮ সালে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।[১২]
গীতিকথা
[সম্পাদনা]রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সম্পূর্ণ আমার সোনার বাংলা গানটি এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই গানের প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি॥
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে—
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব'লে গলার ফাঁসি
বিতর্ক
[সম্পাদনা]গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণের পরপরই জয়া চ্যাটার্জি তার বেঙ্গল ডিভাইডেড গ্রন্থ বর্ণনা করেন, জাতীয় সংগীতে জাতীয় চেতনার যে দমক থাকা জরুরি, সেই দমক আমার সোনার বাংলা গানটিতে নেই।[১৩]
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী আমার সোনার বাংলাকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ১৯৭৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদ একটি কমিটি গঠন করেন যেটি কাজী নজরুল ইসলামের "নতুনের গান" বা ফররুখ আহমেদের "পাঞ্জেরী" গানের সাথে প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করেছিল।[১৪] তবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ অপসারণের পর প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৭৭৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো একটি চিঠিতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, আমার সোনার বাংলা জাতীয় পরিচয় এবং বাংলাদেশিদের সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ এটি একজন অ-বাংলাদেশী একজন ব্যক্তির দ্বারা লেখা ও এখানে দেশীয় চেতনা প্রতিফলন হয়নি। জাতীয় সঙ্গীতের জন্য দেশাত্মবোধক গান "প্রথম বাংলাদেশ" প্রস্তাব করেন।[১৪] তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজেও প্রথম আলো গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতির সময় জাতীয় টেলিভিশন ও সরকারি অনুষ্ঠানে আমার সোনার বাংলা গানটির পরে "প্রথম বাংলাদেশ" গানটি বাজানো হতো। তবে ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর উদ্যোগটি বন্ধ হয়ে যায়।[১৪] ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম উপাচার্য অধ্যাপক আফতাব আহমাদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা বলে নির্যাতনের শিকার হন।[১৫][১৬]
২০০২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর ও তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধন করতে একটি যৌথ সুপারিশপত্র তৎকালীন প্রধামন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে জমা দেন। তবে পরে উক্ত সরকারের মন্ত্রীপরিষদ প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়।[১৭]
২০১৯ সালে, ভারতীয়-বাংলা সঙ্গীতানুষ্ঠান সা রে গা মা পা বাংলায় রানার-আপ হওয়া বাংলাদেশী গায়ক মঈনুল আহসান নোবেল এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, “রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যতটা না দেশকে প্রকাশ করে তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি প্রকাশ করেছে প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটি”। তার এই মন্তব্য বাংলাদেশিদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করে। পরে তিনি নিজের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চান।[১৮]
২০১৯ সালে, ব্রিটিশ-বাংলাদেশী আইনজীবী মুফাসসিল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে মন্তব্য বিতর্কের জন্ম দেন। তিনি বলেন, "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন 'হিন্দুত্ববাদী ব্যক্তি' ছিলেন তাই "ঠাকুরের গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত নয়"।[১৯]
২০২৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গোলাম আজমের মেঝো ছেলে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় জাতীয় সংগীত নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পুনরায় লেখা উচিত, কারণ বর্তমান জাতীয় সংগীতটি মূলত ভারত কর্তৃক প্রণীত”। তার মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত "আমার সোনার বাংলা" গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে দুই বাংলাকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। আযমী বলেন, "বাংলাদেশ স্বাধীন একটি রাষ্ট্র, তাই আমাদের জাতীয় সংগীতও নতুনভাবে হওয়া উচিত।"[২০] তিনি আরও বলেন, "আমরা কি দুই বাংলা এক করার জন্য কাজ করছি, নাকি স্বাধীন বাংলাদেশকে রক্ষা করতে চাই? ১৯৭১ সালে ভারতের চাপের ফলে আমাদের অস্থায়ী সরকার এই সংগীতকে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু এখন সময় এসেছে নতুন একটি জাতীয় সংগীত নির্বাচন করার।" আযমী আরও বলেন, "বাংলাদেশের আরও অনেক সুন্দর গান আছে যা আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা যেতে পারে।"[২১][২২]
কিংবদন্তি
[সম্পাদনা]১৯৪৮ সালে এইচএমভির লেবেলে গানটির গ্রামোফোন রেকর্ড প্রথমবার প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে ইএমআইয়ের লেবেলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত আরেকটি গ্রামোফোন রেকর্ড পরিচিতি লাভ করে।[২]
১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জীবন থেকে নেওয়া চলচ্চিত্রে এই গান ব্যবহৃত হয়েছিল। জহির রায়হান নির্মিত এই চলচ্চিত্রটিতে তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল।[৮]
২০০৬ সালে শ্রোতাদের পছন্দানুসারে বিবিসি বাংলার তৈরি সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় এই গানটি প্রথম স্থান দখল করে।[২৩]
শিল্পকলা সম্পর্কিত দ্য আর্টস ডেস্ক নামক ব্রিটিশ সাংবাদিকতা ওয়েবসাইট ২০১২ সালে স্বর্ণপদক পাওয়ার যোগ্য ১০ টা দেশের জাতীয় সঙ্গীতের তালিকা করে। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত "আমার সোনার বাংলা" স্থান পায়।[২৪]
২০১৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় প্যারেড ময়দানে একসঙ্গে ২,৫৪,৫৩৭ জন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মাধ্যমে গিনেস বিশ্ব রেকর্ড করে।[২৫]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম
- নতুনের গান, বাংলাদেশের রণ সঙ্গীত
- একুশের গান, বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে রচিত গান
- জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত
- বাংলা সঙ্গীত
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ ঙ পাল, প্রশান্তকুমার (১৯৯০)। রবিজীবনী। ৫ম খণ্ড। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা ২৫৮-৫৯।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "'আমার সোনার বাংলা' যেভাবে জাতীয় সংগীত হলো | মুহম্মদ সবুর"। banglanews24.com। ২৬ মার্চ ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাউল (পিডিএফ)। পৃষ্ঠা ৯।
- ↑ "বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও নিষিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ"। সমকাল। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ দত্ত, বিনয় (৪ এপ্রিল ২০২২)। "সাংস্কৃতিক নিবেদিতপ্রাণ সন্জীদা খাতুন"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ Hossain, Selina (৮ মে ২০২৪)। "রবীন্দ্রনাথ সূর্যের মতো বিকিরণ, করেছেন আলো"। Views Bangladesh। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "রমনা বটমূল, ছায়ানট এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ"। www.kalerkantho.com। মে ২০১৯। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ গ ঘ "আমার সোনার বাংলা' যেভাবে জাতীয় সংগীত হলো"। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪। ২০২৪-০৯-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ওয়াজেদ মিয়া, এম এ (১৯৯৭)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ। ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। পৃষ্ঠা ৬৪। আইএসবিএন 9840501348।
- ↑ "যেভাবে হয়েছিল প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান"। দ্য ডেইলি স্টার। ১৭ এপ্রিল ২০২৪।
- ↑ ইসলাম, উদিসা (১৩ জানুয়ারি ২০২০)। "১৩ জানুয়ারি: মন্ত্রিসভায় জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্ধারণ"। বাংলা ট্রিবিউন। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "জাতীয় সংগীত গাইতে হবে নিয়ম মেনে"। প্রথম আলো। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ উল্লাহ, মাহবুব (১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। "শতফুল ফুটতে দাও: বিতর্কের উত্তেজনায় যাতে গণতন্ত্র হারিয়ে না যায়"। যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০২৪।
- ↑ ক খ গ "যে ৩ সময়ে 'জাতীয় সংগীত' পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল"। Jugantor। ৭ আগস্ট ২০১৯। ১৮ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ জুলাই ২০২৪।
- ↑ "গুলিবিদ্ধ অধ্যাপক আফতাব মারা গেছেন"। www.bbc.com। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-৩০।
- ↑ "প্রথম যিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন ,তাকে খুন করা হয়েছিলেন!"। এখনই সময় (ইংরেজি ভাষায়)। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-৩০।
- ↑ "যে ৩ সময়ে 'জাতীয় সংগীত' পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল"। দৈনিক যুগান্তর। ৭ আগস্ট ২০১৯। ১৮ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "'জাতীয় সংগীত' নিয়ে মন্তব্য করে নতুন বিতর্কে নোবেল"। দৈনিক যুহান্তর। ১ আগস্ট ২০১৯। ১২ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ Basu, Subho (২০২৩-০৫-৩১)। Intimation of Revolution: Global Sixties and the Making of Bangladesh (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 62। আইএসবিএন 978-1-009-32987-3।
- ↑ "নতুন করে সংবিধান ও জাতীয় সংগীত রচনার দাবি আয়নাঘরফেরত আযমীর"। www.kalerkantho.com। ২০২৪-০৯-০৩। ২০২৪-০৯-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-০৫।
- ↑ "জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পরিবর্তন চান আমান আযমী"। জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পরিবর্তন চান আমান আযমী। ২০২৪-০৯-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-০৫।
- ↑ "৩ লাখকে ৩০ লাখ বলে ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিব: ব্রিগেডিয়ার আযমী"। যুগান্তর। ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "বিবিসি বাংলা"। ৩১ মে ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০১৩।
- ↑ "The best and worst national anthems? Time to award the medals"। theartsdesk.com (ইংরেজি ভাষায়)। ১৫ এপ্রিল ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ "Guinness accepts national anthem record"। ঢাকা ট্রিবিউন। ২০১৪-০৪-১০। ১৬ মে ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৫-২১।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- বাংলাপিডিয়ায় আমার সোনার বাংলা
- "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান – প্রথম ভাগ - জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা ও প্রতীক"। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ১১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।