বিষয়বস্তুতে চলুন

রেবন্ত

এটি একটি ভালো নিবন্ধ। আরও তথ্যের জন্য এখানে ক্লিক করুন।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

রেবন্ত
অশ্বের দেবতা
অশ্বের ঐশ্বরিক প্রভু
অন্তর্ভুক্তিগুহ্যক
আবাসহিমালয়
অস্ত্রতলোয়াড়
বাহনঘোড়া
ব্যক্তিগত তথ্য
মাতাপিতাসূর্য (পিতা) এবং সঞ্জনা (দেবী) (মাতা)
সহোদরঅশ্বিনীকুমার, যমরাজা, যমুনা, শনি, তপতী এবং বৈবস্বত মনু
দম্পত্য সঙ্গীবন্দনা
লোচনা
মাধবী

রেবন্ত বা রাইভত (সংস্কৃত: रेवन्त, আক্ষরিক অর্থ "উজ্জ্বল") হলেন একজন হিন্দু দেবতা। ঋগ্বেদ অনুযায়ী, রেবন্ত হলেন প্রধান সৌর দেবতা সূর্য এবং তার স্ত্রী সঞ্জনার কনিষ্ঠ সন্তান। রেবন্ত হলেন যক্ষ প্রভৃতি উপদেবতা ও দানবীয় সত্ত্বা গুহ্যকদের (गुह्यक) প্রধান। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, এই যক্ষেরা হিমালয়ের বনাঞ্চলে বাস করেন।[][] রেবন্তের প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্যে প্রায়শই তাঁকে ধনুর্বানধারী অশ্বারোহী এক শিকারী পুরুষের রূপে দেখা যায়।

রেবন্তের উপাসনা মধ্যযুগীয় পূর্ব ভারতে ( বিহার ও বাংলা ) বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল এবং অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যা ৬ষ্ঠ শতকে শুরু হওয়া অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়।

রেবন্ত হলেন আরোগ্য, দৃষ্টি, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের যমজ দেবতা অশ্বিনীকুমারদের ভাই।

কিংবদন্তি

[সম্পাদনা]

রেবন্তের জন্মের উপাখ্যান বিষ্ণু পুরাণ এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞা ছিলেন সূর্যের পত্নী। তিনি সূর্যের অনুগ্রহ লাভে বঞ্চিত হয়ে নিজের প্রতিচ্ছায়া ছায়াকে সূর্যের কাছে রেখে বনে গিয়ে এক ঘোটকীর রূপ ধারণ করে কঠোর তপস্যায় রত হন। ছায়া যে সংজ্ঞা নন, সে কথা বুঝতে পেরে সূর্য সংজ্ঞাকে খুঁজতে বের হন এবং উত্তর কুরুতে তাঁর সাক্ষাৎ পান। তারপর তিনি ঘোড়ার ছদ্মবেশে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন এবং তাঁদের মিলনের ফলে যমজ অশ্বিনীকুমার এবং রেবন্তের জন্ম হয়।[] কূর্মপুরাণ এবং মৎস্যপুরাণে রেবন্তের মাতার নাম হলো রাত্রি, যিনি হলেন সূর্যের আরেক স্ত্রী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্য একটি অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, তিনি হলেন ছায়ার পুত্র এবং তার ভাইয়েরা হলেন শনিদেব, তপতী এবং ভদ্র[][]

মার্কণ্ডেয় পুরাণে আরও লেখা আছে যে সূর্য তাকে গুহ্যকদের শাসক এবং "শত্রু ও লুটেরাদের থেকে, প্রকান্ড অগ্নিকাণ্ড থেকে বন-জঙ্গল এবং অন্যান্য নির্জন ভূমির আতঙ্ক অভান্তরকে" রক্ষার দায়িত্বে অর্পণ করেন। কখনো কখনো, রেবন্তকে পরিত্রাণের জন্য লুটেরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অবস্থায় বর্ণনা করা হয়।[]

দেবীভাগবতেও একটি স্থানে ছোটো করে রেবন্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একদা যখন রেবন্ত সাতটি মস্তকবিশিষ্ট ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবার উপর চড়ে বৈকুন্ঠে যাত্রা করেন, বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী ঘোড়াটিকে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যান এবং বিষ্ণুর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নকে উপেক্ষা করেন। এই কারণে, লক্ষ্মী তার স্বামীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে ঘোটকীতে পরিণত হন।[]

মূর্তিতত্ত্ব

[সম্পাদনা]

মার্কণ্ডেয় পুরাণে রেবন্তের বর্ণনায় পাওয়া যায়, তিনি “বর্মপরিহিত, তরবারি, তূণীর, তির ও ধনুর্ধারী এক অশ্বারোহী।[] কালিকা পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি ডান হাতে তরবারি ও বাঁ হাতে চাবুক নিয়ে সাদা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার। এই কারণে, তিনি হয়বাহন (অশ্বারোহী) নামেও অভিহিত হন। বরাহমিহিরে তাঁকে সপার্ষদ শিকারী পুরুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[]

ভাস্কর্যে রেবন্তকে তাঁর অনুচর গুহ্যকদের সঙ্গে শিকাররত অবস্থায় দেখা যায়। ধনুক, তরবারি ইত্যাদি গ্রন্থে বর্ণিত অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও কোনও কোনও ভাস্কর্যে তাঁর হাতে মদ্যপাত্রও/মদের পাত্রও দেখা যায়। অনেক মূর্তিতেই দেখা যায়, রেবন্ত পায়ের গুল্‌ফ পর্যন্ত বুটজুতার মতো পাদুকা পরিধান করেছেন।[][১০] এখানে উল্লেখ্য, সূর্য ছাড়া অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীদের সাধারণত নগ্নপদ মূর্তিই নির্মিত হয়ে থাকে। কোনও কোনও মূর্তিতে দেখা যায়, অশ্বারহী রেবন্তের সহচর একটি শিকারী কুকুর। রেবন্তের অনুচরদের হাতে বর্শা ও তরবারির মতো শিকারের নানান ধরনের অস্ত্র দেখা যায়। কয়েক জন অনুচর শঙ্খবাদনরত অবস্থায় রয়েছেন অথবা ঢাক-ঢোল বাজাচ্ছেন অথবা তাদের প্রভুর মাথায় ছাতা ধরে রয়েছেন। এই ছাতাটি রাজপদের প্রতীক।[১১] এছাড়াও তাদের কারও কারও চিত্র অঙ্কিত হয়েছে উড়ন্ত অবস্থায় অথবা মদ বা জলের পাত্র হাতে ধরা অবস্থায়। কোনও কোনোও মূর্তিতে দেখা যায়, রেবন্তের এক অনুচর কাঁধে করে একটি মৃত বন্য বরাহ নিয়ে যাচ্ছে অবথা পূর্বোক্ত শিকারী কুকুরটি একটি বন্য শূকরকে ধাওয়া করেছে।[১২]

রেবন্ত, যোদ্ধা ও অশ্বের রক্ষক, অরণ্যের বিপদে ত্রাণকর্তা ও শিকারীদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পূজা করা হত।[১১] তাঁর পূজার সঙ্গে সূর্যোপাসক সৌর সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণকালিকা পুরাণের মতো কয়েকটি গ্রন্থে সূর্যের সঙ্গে রেবন্তের অথবা সূর্যপূজার বিধি অনুযায়ী রেবন্তের পূজার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[] শব্দকল্পদ্রুম গ্রন্থের বিবরণ থেকে জানা যায়, যোদ্ধাদের দ্বারা হিন্দু মাস আশ্বিন মাসে যোদ্ধারা সূর্যপূজার পর রেবন্তের পূজা করতেন।[১৩] চতুর্থ পাণ্ডব, নকুলকে ঘোড়া-বিষয়ক অশ্বশাস্ত্রম্ গ্রন্থের রচয়িতা বলে মনে করা হয়। তিনি প্রেতাত্মাদের হাত থেকে ঘোড়াদের রক্ষা করার জন্য রেবন্ত পূজার বিধান দিয়েছিলেন।[১৩]

মধ্যযুগের প্রথম পর্বে, বিশেষত রাজস্থানে, রেবন্তের পূজা বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। তাঁকে অধিকাংশই বৈষ্ণবধর্ম এবং সূর্য মন্দিরে লক্ষ্য করা যায়।[১৪] রেবন্তের একটি মন্দিরের সম্পর্কে তুলে ধরা একটি শিলালিপি রয়েছে, যা বিকর্ণপুরে (বর্তমানে কোটগাফ, মধ্যপ্রদেশ) কলচুরির রাজা দ্বিতীয় রত্নদেব দ্বারা নির্মিত এবং এই মন্দিরের প্রধান দেবতা হলেন রেবন্ত।[১৫]

পাদটীকা

[সম্পাদনা]
  1. Monier-Williams Dictionary: Revanta
  2. "Monier-Williams Dictionary:Guhyaka"। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জানুয়ারি ২০২১ 
  3. Singh 1997, পৃ. 2605–6
  4. ড্যানিয়েলো, অ্যালাইন (১৯৯১), The Myths and Gods of India: The Classic Work on Hindu Polytheism, ইনার ট্র্যাডিশন / বিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি, পৃষ্ঠা ৯৬, আইএসবিএন 0-89281-354-7 .
  5. তালাকদার, এ (২০০৮), "XI", The Matsya Puranam: Part I, The Sacred books of the Hindus, ১৮, কসমো পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ৩২, আইএসবিএন 81-307-0532-X 
  6. মিশ্র, বিভূতিভূষণ (১৯৭৩), Religious Beliefs and Practices of North India During the Early Mediaeval Period, ব্রিল, পৃষ্ঠা 37, আইএসবিএন 90-04-03610-5 .
  7. ডোনিগার ওফ্ল্যাহার্টি, ওয়েন্ডি (১৯৮০), Women, androgynes, and other mythical beasts, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস, পৃষ্ঠা ২১৮, আইএসবিএন 0-226-61850-1 .
  8. সিং ১৯৯৭, পৃ. ২৬০৬
  9. সিং ১৯৯৭, পৃ. ২৬১১, ২৬১৩
  10. কালিয়া, আশা (১৯৮২), Art of Osian Temples: Socio-Economic and Religious Life in India, 8th-12th Centuries A.D., অভিনব পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ১১৯–১২০, আইএসবিএন 0-391-02558-9 
  11. A History of Zoroastrianism by Mary Boyce, Frantz Grenet, Roger Beck pp.485-6
  12. সিং ১৯৯৭, পৃ. ২৬০৬–১৪
  13. সিং ১৯৯৭, পৃ. ২৬০৭
  14. সিং ১৯৯৭, পৃ. ২৬০৯
  15. সিং ১৯৯৭, পৃ. ২৬১৫-১৬

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  • সিং, নগেন্দ্র কুমার (১৯৯৭), "Revanta in Puranic Literature and Art", Encyclopaedia of Hinduism, ৪৪, আনমোল পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ২৬০৫–১৯, আইএসবিএন 81-7488-168-9 .

আরও পড়ুন

[সম্পাদনা]
  • বিজেন্দ্র নাথ শর্মা কর্তৃক আইকনোগ্রাফি অব রেবন্ত, ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত, অভিনব প্রকাশনা, ৮৬টি পাতা, আইএসবিএন ০-৭১২৮-০১১৬-২.
  • এম. এল. কার্টার (১৯৮৮), রেবন্ত, অ্যান ইন্ডিয়ান ক্যাভালিয়ার গড, আন্নালি ডেল'ইস্তিতুতো ওরিয়েন্তালে দি নাপোলি, ভলিয়ম ৪৮, গুচ্ছ ২ (১৯৮৮)