মোরসালিন মিজান ॥ ওয়াজ মাহফিলে নীতিবাক্য কপচালেও, বাস্তবে মামুনুল হক আপাদমস্তক এক ভ-। বর্ণচোরা যুবকের কাম এবং ক্রোধের কাছে আর সব নস্যি। হেফাজতের তা-বে গোটা দেশ যখন স্তম্ভিত তখন মূল উস্কানিদাতা হুজুরবেশী প্লেবয় রিসোর্টে নারীসহ মৌজ করছিলেন। আল্লাহর কসম কেটে সীমিত পরিসরে মিথ্যা বলার শাস্ত্র চালু করা বহুগামী ধর্ম ব্যবসায়ীর জীবনে আসলে সত্য বলে কিছু নেই।
মামুনুল হকের গত কিছুদিনের কর্মকা-, ফোনালাপ, স্বীকারোক্তি ও পুলিশের দেয়া তথ্য থেকে এমন ধারণাই পাওয়া যাচ্ছে। একইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইসলাম হেফাজতের নামে ‘ঠিকাদারি’ শুরু করা হেফাজতে ইসলামের নীতি-আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নতুন করে।
গত ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে সরকার। দশ দিনব্যাপী আয়োজনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। একই উপলক্ষে আমন্ত্রণ জানানো হয় একাত্তরে চরম দুর্দিনে সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে পাশে দাঁড়ানো ভারতকে। বন্ধুরাষ্ট্রের পক্ষে গত ২৬ মার্চ অনুষ্ঠানে যোগ দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারও আগে থেকে এ সফরের বিরোধিতা শুরু করে পাকিস্তানী ভাবাদর্শ লালন করা হেফাজতে ইসলাম। প্রশাসনের অনুনয়বিনয় উপেক্ষা করে ক্রমেই উগ্র হয়ে ওঠে তারা।
বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ বলছে, অনুসারীদের উস্কে দিতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। ইউটিউবে আপলোড করা এক ওয়াজের ভিডিওতে দেখা যায়, নরেন্দ্র মোদির সফর ঠেকাতে ‘জিহাদের ময়দানে’ নামার ডাক দিচ্ছেন তিনি। চরম উগ্রবাদী নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘মুসলমান যত মরে ইসলাম তত তাজা হয়। ইসলাম নামক এই বৃক্ষের গোড়ায় শাহাদাতের যত রক্ত ঝরবে এই বৃক্ষ ততই সজীব হবে। মুসলমান মরলে ইসলাম মরে না। মুসলমান যত মরে ইসলাম তত জিন্দা হয়।’
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে এ ধরনের উত্তেজক বক্তৃতা করতে দেখা যায় মামুনুলকে। অভিযোগ রয়েছে, তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশনায় ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে তা-ব চালায় কওমি মাদ্রাসার উগ্র ছাত্ররা। হরতালের নামে থানা আক্রমণ, হাইওয়ে অবরোধ, আগুন দিয়ে রেলস্টেশন, সরকারী গুরুত্বপূর্ণ অফিস, বাড়িঘর পোড়ানোসহ ব্যাপক নাশকতা চালায় জঙ্গীগোষ্ঠী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিত্র ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। হরতালসহ তিন দিনের কর্মসূচীতে গোটা শহর ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে সব ছারখার করে দেয় উগ্রবাদীরা। মামুনুলের ‘ইসলাম তত তাজা’ করতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ১৭ জনের প্রাণ হারানোর খবর পাওয়া যায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দ কেড়ে নিয়েও খ্যান্ত হন না মামুনুল। সর্বশেষ বায়তুল মোকাররমের সামনে দাঁড়িয়ে তা-ব অব্যাহত রাখার হুমকি দেন তিনি।
এ অবস্থায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যখন চরমে তখন গত ৩ এপ্রিল সামনে আসে মামুনুলের প্রকৃত চেহারা। জানা যায়, অনুসারীদের বিভ্রান্ত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে নিজে তিনি জীবন উপভোগে ব্যস্ত। স্ত্রী ঘরে রেখে পরনারীসহ সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে উঠে দরজায় খিল দিয়েছেন। ওই দিন সন্ধ্যায় রয়্যাল রিসোর্টে স্থানীয়দের হাতে আটক হন মামুনুল। কাম ক্রোধে উন্মত্ত যুবকের ‘ধরা খাওয়া’ চেহারা ফেসবুক লাইভে হঠাৎ দেখে ছেলে-বুড়ো সকলেরই আক্কেলগুড়ুম অবস্থা হয়। এই তাহলে মাওলানা মামুনুল হক? লজ্জায়, ঘৃণায় অনেককে কুঁচকে যেতে দেখা যায়।
জানা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে রিসোর্ট কা-ের সত্যতা নিয়ে মামুনুলের শত্রুদেরও কিছুটা সংশয় ছিল। কিন্তু জট খুলতে বেশি সময় লাগেনি। ফেসবুক লাইভে দেখা যায়, ঘটনার শুরুতে মামুনুল হক স্থানীয়দের কাছে দাবি করছেন, সঙ্গে থাকা নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী। সত্য বলছেন প্রমাণ করতে ‘আল্লার কসম’ কাটতেও দ্বিধা করেন না তিনি। জানান, নারীটির নাম আমেনা তৈয়্যবা। ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ওই নারীকে তিনি বিয়ে করেছেন। একই সময় আলাদাভাবে ওই নারীর কাছে তার নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি জান্নাত আরা ঝর্ণা বলে নিজের পরিচয় দেন। পরে জানা যায়, আমেনা তৈয়্যবা আসলে মামুনুলের প্রকৃত স্ত্রীর নাম। বাসায় থাকা স্ত্রীর নাম রিসোর্টের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করেছিলেন মামুনুল। বোরকায় আড়াল করে রিসোর্টে নিয়ে যান ঝর্ণাকে। পর্দা প্রথার ওপর বেদম বক্তৃতা করা হুজুর নিজেই এভাবে বোরকাকে চৌর্যবৃত্তির কাজে ব্যবহার করেন।
ঘটনার পরপরই ফাঁস হওয়া এক ফোনালাপ থেকে জানা যায়, মামুনুল তার প্রকৃত স্ত্রীকে বলছেন, ওই মহিলা যে ছিল সঙ্গে সে হইলো আমগো শহীদুল ইসলাম ভাইয়ের ওয়াইফ। বুঝছো? ...তুমি বিষয়টা মানে অন্য কথা বলতে হইবো, পরিস্থিতিটা এমন হইয়া গেছে।’ স্ত্রীকেও মিথ্যা বলার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তোমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে তুমি বইলো হ্যাঁ, আমি সব জানি। এইরকম কিছু একটা বইলো।’
একই রকম ফোনালাপে মামুনুলের বোন মামুনুলের স্ত্রীকে এ বিষয়ে সত্য গোপন করার ও মিথ্যা বলার পরামর্শ দেন। মামুনুলের বোন বলেন, কেউ যদি তাকে (মামুনুলের স্ত্রী) ফোন করে, তাহলে তিনি যেন বলেন, তিনি নিজে বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন এবং তার শাশুড়ি এই বিয়ের আয়োজন করে গেছেন। এ ফোনালাপ থেকে মামুনুলের পারিবারিক নীতিবোধ সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।
পরে ঝর্ণার বড় ছেলে আব্দুর রহমানও ভিডিও বার্তায় নিশ্চিত করেন, তার মায়ের সঙ্গে মামুনুলের বিয়ে হয়েছে এমন কিছু তাদের জানা নেই। মামুনুল তার মায়ের আর্থিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়েছে। এ জন্য মামুনুলের প্রতি তীব্র ঘৃণাও প্রকাশ করতে দেখা যায় সন্তানকে।
এরই মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় ঝর্ণার নিজের হাতে লেখা তিনটি ডায়েরি। ডায়েরিগুলোও মামুনুলের চরিত্র বুঝতে সহায়তা করে। ৩০০ পাতার ডায়েরিতে ঝর্ণা লিখেছেন, ‘আমাকে বিয়ে না করেই গ্রীন রোডের একটি বাসায় রাখেন মামুনুল হক। আমাকে খরচের টাকাও দিতেন। কিন্তু বিয়ে করে স্ত্রী বানাননি।’ অন্য জায়গায় তিনি লিখেছেন, সে (মামুনুল) আমার জীবনকে নরক বানিয়ে ফেলছে।’
ডায়েরি নিজে পাঠ করে শুনিয়ে ঝর্ণার অসহায় সন্তান বলেন, মুখোশধারী মানুষকে দাড়ি-টুপিতে চেনা যায় না। মামুনুল হকের বিচারও দাবি করেন তিনি।
মামুনুলকে ‘জঘন্য’ লোক আখ্যা দিয়ে বিএনপির অঘোষিত উপদেষ্টা ডাঃ জাফর উল্লাহ বলেন, ‘রোম যখন পুড়ছিল নীরু তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ বাংলাদেশ যখন পুড়ছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া যখন পুড়ছে উনি (মামুনুল)তখন ফুর্তি করতে গেছেন রিসোর্টে।
আরও অনেকের সমালোচনার মুখে মামুনুল ফেসবুক লাইভে এসে ফাঁস হওয়া ফোনালাপ তার নিজের বলে স্বীকার করেন। এ সময় উদ্ভট নীতিশাস্ত্র প্রবর্তন করে তিনি বলেন, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে, স্ত্রীকে খুশি করতে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে কোন সত্যকে গোপন করা যায়। পরনারীর সঙ্গকে ‘ব্যক্তিগত’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের সম্মতিতে যে সম্পর্ক তা নিয়ে প্রগতিশীল চিন্তার মানুষরা কখনও আপত্তি করেন না। এ নিয়ে ফতোয়া দিতে দেখা যায় কট্টরপন্থীদেরই। হেফাজতও নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাই পা দিয়েছে বলে মনে করা হয়।
এদিকে, ঘটনার এখানেই শেষ বলে ধারণা করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। ছায়া অনুসন্ধান করতে গিয়ে মামুনুলের তৃতীয় সঙ্গিনীর সন্ধান পায় পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, জান্নাত আরা ঝর্ণার মতো ডিভোর্সি এই নারীর সঙ্গেও মামুনুল হকের শারীরিক সম্পর্ক ছিল। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েই মহিলা মাদ্রাসার ওই শিক্ষকের সঙ্গেও দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন মামুনুল হক। মোদিবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই তিনি ওই নারীর বাসায় গিয়ে একান্ত সময় কাটান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ৪৯ সেকেন্ডের এক অডিওতে শোনা যায়, মামুনুল ওই নারীকে বলছেন, ‘হ্যালো, আমি আসছি।’ উত্তরে ওই নারী বলেন, ‘চলে আসছেন? গেট খোলা আছে।’ মামুনুল বলেন, ‘গেট খুলে আমাকে রিসিভ করার ব্যবস্থা করো। এছাড়া কেউ আছে নাকি দেখো আগে।’ বাসা থেকে বের হওয়ার পরে বান্ধবীকে ‘ফ্রেশট্রেস’ হওয়ারও পরামর্শ দেন বহুগামী মামুনুল। হেফাজতে ইসলামের এই নেতার বিরুদ্ধে বলাৎকারের ঘোরতর অভিযোগও পাওয়া গেছে।
অথচ এই নেতাকে এক ওয়াজে বলতে শোনা যায়, ‘কম্বাইন্ড এডুকেশনের নামে সহশিক্ষার নামে ছেলে আর মেয়েদের উঠতি বয়স থেকে ফ্রি সেক্সের ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয়েছে।’ অন্যকে ছোট করা সেই মামুনুলের নাক কাটা যায় একাধিক ঘটনায়। এসব ঘটনায় ইসলামের হেফাজত নয় চরম অসম্মান হয়েছে বলে মনে করেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।
বিশ্লেষকদের মতে, মামুনুলের ধর্মের নামে অধর্ম করে বেড়ানোর ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের অন্ধকার দিকটাও আরেক দফা সবার নজরে এসেছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে একইরকম মিথ্যার বেসাতি করা হয়েছে। গোড়ারদিকে সংবাদ সম্মেলন করে ফাঁস হওয়া ফোনালাপগুলোকে সাজানো বলে দাবি করেন দায়িত্বশীলরা। কিন্তু মামুনুল নিজে ফোনালাপের সত্যতা স্বীকার করে নিলে তার সাফাই গাওয়া নেতারা পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণিত হন। একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালানো তা-ব তারা সংঘটিত করেননি বলে দাবি করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু মামুনুল নন, সংগঠনটি যে মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে সাম্প্রতিক কর্মকা- ও কথাবার্তায় তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সত্য স্বীকার না করলেও নৈতিকভাবে দুর্বল হেফাজতে ইসলাম বর্তমান পরিণতি টের পেয়ে পিছুটান দিয়েছে। ক্রমে সুর নরম করছে তারা। তবে আইন চলছে আইনের নিজস্ব গতিতে। রাষ্ট্র ও সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন সময়ে তা-ব চালানো জঙ্গী নেতারা একে একে গ্রেফতার হচ্ছেন। গ্রেফতার এড়াতে পারেননি মামুনুল হক নিজেও।
জানা যায়, মতিঝিলে ২০১৩ সালে চালানো তা-বে নেতৃত্ব দেয়া অন্যতম নেতা মামুনুলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলা ছিল। সেসব মামলায় তিনি কোনদিন আদালতে হাজিরা পর্যন্ত দেননি।
পুলিশ বলছে, এভাবে দেশের প্রচলিত আইন এবং ধর্মীয় অনুশাসন সব উপেক্ষা করে ধর্মব্যবসা উগ্রবাদ আর কাম ক্রোধে মত্ত ছিলেন মামুনুল হক।