
ওয়ালি উল্লাহ আরমান
নব্বই দশকে ইসলামী রাজনীতির উত্তাল সময়ের কথকতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলা হয়নি। সেটা হচ্ছে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর আহবানে সংঘটিত ‘বাবরি মসজিদ অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চ’ কর্মসূচি।
হিন্দুস্তানের অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদে গেরুয়া বসনধারী উগ্রবাদী হিন্দুরা ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালায়। এর ফলে সমগ্র উপমহাদেশের মুসলমানদের হৃদয় কষ্টে, ক্ষোভে, যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠে।
বাঙলাদেশে এই ঘটনায় আন্দোলনের আগুন জ্বলে ওঠে। এই সুযোগে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের দুরভিসন্ধিতে কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপরে আক্রমণের চেষ্টা চলে। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ভিন্নধর্মের প্রতি সহনশীল ও নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে আলেম-ওলামা এবং সত্যিকার ইসলাম চর্চাকারীদের তৎপরতায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন নাটক মঞ্চায়নের প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
স্বাধীনতাত্তোর ৪৮ বছরে বাংলাদেশে সামাজিক অথবা ধর্মীয় ক্ষেত্রে সহাবস্থানের প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, এখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাদের বাড়িঘর অথবা উপাসনালয়ে হামলার বিচ্ছিন্ন ঘটনায় আলেম-ওলামা কিংবা ইসলামপন্থিদের ভূমিকা কখনোই ছিল না। এর জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে দেশের সর্ববৃহৎ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা মসজিদের ঠিক ২৫/৩০ গজ দূরত্বে অবস্থিত হিন্দু সম্প্রদায়ের কালী মন্দিরের কথা বলা যায়। সেখানে দিনের যেকোনো সময় মাইক বাজিয়ে, ঢোলতবলা পিটিয়ে পূজা-পার্বণ করা হলেও কোন একটি দিন, এক মুহূর্তের জন্যও এই পূজা পালনে কেউ আপত্তি কিংবা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি।
ঢাকা কোতোয়ালির শাঁখারিপট্টি ও তাঁতিবাজারে প্রচুর হিন্দু বাস করে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় পুরান ঢাকায় উত্তেজনা দেখা দিলে ইসলামপুর তাঁতিবাজারে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার শত শত ছাত্র শিক্ষক শাঁখারিপট্টি ও তাঁতিবাজারে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, স্থাপনা এবং উপাসনালয় পাহারা দেয়।
মিরপুর জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ এর তিন দিকে তিনটি হিন্দু পল্লী রয়েছে, যা ঋষিপাড়া, হরিরামপুর বাজারপাড়া এবং পালপাড়া হিসেবে পরিচিত। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আরজাবাদ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
তখন এদেশে ইসলামী রাজনীতির অবিসংবাদিত এবং প্রভাবশালী নেতা ছিলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। বিদেশী শক্তির প্রতি বাংলাদেশের নতজানু সরকার বাবরি মসজিদ ভাঙার কোন প্রতিবাদ না করলেও তৌহিদী জনতার ঈমানদীপ্ত দাবিকে সামনে রেখে শায়খুল হাদীস রহ. ঢাকা থেকে বাবরি মসজিদ অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চের আহ্বান করেন।
এই লংমার্চ কর্মসূচির সদস্য সচিব ছিলেন মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন এআরএম আব্দুল মতিন, অধ্যাপক আখতার ফারুক রহ., ড. আহমদ আবদুল কাদের বাচ্চু প্রমূখ।
১৯৯৩ সালের ২জানুয়ারি ঢাকা বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে বেনাপোল অভিমুখে বাবরি মসজিদ রক্ষার দাবিতে লংমার্চের যাত্রা শুরু হয়। আমি তখন জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদে হেদায়াতুন্নাহু কিতাব পড়ি। আমরা জমিয়ত ঘরানার হবার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে, ঘোষণা দিয়ে লংমার্চে অংশগ্রহণের সুযোগ পাইনি। নতুবা লংমার্চে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বন্ধুদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আগ্রহের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু লংমার্চের রুট গাবতলী বাস টার্মিনালের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল আরজাবাদ মাদ্রাসা। ফলে অন্য মাদ্রাসার পরিচিত যারা লংমার্চ কাফেলার যাত্রী হয়েছিল, ওদের বিদায় জানাতে এবং লংমার্চের সার্বিক চিত্র দেখার জন্য আমরা দলবেঁধে গাবতলী টার্মিনালে গিয়েছিলাম।
মূলত এই লংমার্চ কর্মসূচি ছিল সীমিত ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগে প্রতিবাদের আওয়াজ উচ্চকিত করে, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুস্তানের কানে নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশের মুসলমানদের ক্ষোভের আওয়াজ পৌঁছে দেওয়ার দুর্নিবার প্রয়াস। এই ভূখণ্ডে এর আগে ও পরে বহুবার ধর্মীয় ভাবাবেগে উৎসারিত অন্যান্য আন্দোলনের মত বাবরি মসজিদ রক্ষার জন্য ভারত অভিমুখে লংমার্চেও বিক্ষুব্ধ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অংশগ্রহণ ছিল বাঁধভাঙা স্রোতের মতো।
কিন্তু রাষ্ট্রের দিক থেকে প্রতিকূলতার মোকাবেলাও করতে হয়েছে। কারণ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশের উপর বিশাল প্রতিবেশী সম্প্রসারণবাদী হিন্দুস্তান এর পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ আসবে, এটা বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম সচেতন যে কেউ বুঝবেন।
বর্তমানে বাংলাদেশকে হিন্দুস্তান আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে বেঁধে ফেলেছে যে, অগণিত মুসলমানকে আসাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া কিংবা হিন্দুস্তানের নাগরিক তালিকা থেকে খারিজ করার ব্যাপারে এখন আর এদেশ থেকে কেউ কথা বলার সাহস রাখে না। তদুপরি নৈতিক বলে বলিয়ান হয়ে কেউ প্রতিবাদ করলেও কোন মিডিয়া সেই প্রতিবাদের সংবাদ ছাপবে বলে মনে হয় না।
তারপরেও তৎকালীন বিএনপি সরকার যাদের অন্যতম দলীয় মূলনীতি ছিল বাংলাদেশের স্বার্থে হিন্দুস্তানের সামনে বশ্যতা স্বীকার কিংবা নমনীয়তা প্রদর্শন না করা, তারা এই লংমার্চের বিরোধিতা করে। ঢাকা থেকে শুরু হওয়া লংমার্চ সাভার, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাগুরা হয়ে যশোর বাসস্ট্যান্ডে সমাবেশ শেষে বেনাপোলের দিকে ১৬ মাইল পথ অতিক্রম করে ৪জানুয়ারি ঝিকরগাছা পৌঁছলে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যারিকেড দেয়া হয়। এরপরেও বিক্ষুব্ধ তৌহিদী জনতা পায়ে হেঁটে ইন্ডিয়ার দিকে অগ্রসর হতে চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ৪ জন। ঝিকরগাছায় মাগরিব আদায়ের পর শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. লংমার্চ স্থগিত ঘোষণা করেন।
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ অভিমুখে আহুত ওই লংমার্চে সাইড রোলে অনেকে থাকলেও মূল নেতা ছিলেন একজনই, তিনি শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.।
এর আগে খেলাফত আন্দোলনের যেমন একক নেতা ছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.। এরপরে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির মূল নেতা ছিলেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.। নিকট অতীতে হেফাজতে ইসলামের দেশকাঁপানো নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত একক নেতা শাহ আহমদ শফী হাফিজাহুল্লাহ।
জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, আপাতত তেমন জাগরণী কোন নেতা চোখে পড়ছে না যার ডাকে খেলাফত আন্দোলন, বাবরি মসজিদ রক্ষা, ফতোয়া বিরোধী রায় বাতিল কিংবা নাস্তিক-মুরতাদদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল জনজোয়ার সৃষ্টিকারী আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। কারো ডাকে বিপুল জনসমাবেশ হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু সেই সমাবেশ প্রসঙ্গে দেশ, জাতি, সরকার, প্রশাসন কিংবা দেশী-বিদেশী সচেতন মহল খুব একটা রা করে না। জনমনে সামান্যতম আলোড়নও সৃষ্টি হয় না।
সম্ভবত এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, অতীতের সবগুলো আন্দোলনই ছিল ইসলামের কল্যাণে, এখলাসের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে। কিন্তু আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া ওই আন্দোলনগুলোর পরিণতি ভাবলে হতাশা, দুঃখ ও কাতরতা আমাদেরকে বিষাদগ্রস্ত করে। এর নেপথ্যের কারণ এই হতে পারে যে, এই সকল আন্দোলনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেয়ার মতো প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা আমাদের নেই, অথবা শীর্ষ নেতৃত্বের আশেপাশে সজাগ, সচেতন, দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গের তুলনামূলক কম উপস্থিতির কারণে ফাইনালি রেজাল্ট অন্যের ঘরে চলে যায়।
এ সবগুলো আন্দোলনই মূলত ইসলাম, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, ঈমান-আকীদা এবং রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা সংরক্ষণের জন্য সংঘটিত হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে এ আন্দোলনগুলির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
জানি না, বিভিন্ন সময়ে এই ভূখণ্ডে যুগচাহিদার আলোকে দানা বেঁধে ওঠা উত্তাল ঈমানী আন্দোলনগুলো জাতির ভাগ্যাকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয় উল্কাপিণ্ডের মত কেন খসে পড়ে? কিন্তু এটাও সত্যি যে হযরত হাফেজ্জী রহ., শায়খুল হাদীস রহ., মুফতি আমিনী রহ. এবং শাহ আহমদ শফী হাফিজাহুল্লাহ-র নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের কথা মনে করে বাতিলের দুর্গে এখনও কম্পনের সৃষ্টি হবে। সাহসিকতা ও সচেতনতার এই সোনালী ইতিহাস যুগে যুগে আমাদের জন্য আলোকবর্তিকার কাজ করবে, আমরা এখান থেকে উৎসাহ-উদ্দীপনা, চেতনা ও প্রেরণা লাভ করবো।
( চলবে )
লেখক: আলেম ও রাজনীতিবিদ
প্রথম কিস্তি : ফিরে দেখা নব্বই দশক : উত্তাল সময়
দ্বিতীয় কিস্তি : ইসলামী ঐক্যজোট: ঐক্যের নতুন প্লাটফর্ম
তৃতীয় কিস্তি : সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের তৎপরতা
চতুর্থ কিস্তি : জমিয়ত ও মজলিসে বৈরিতা