মুহাম্মদ আবদুল আযিয:
হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ. উপমহাদেশের অন্যতম আইকনিক ব্যক্তিত্ব। উপমহাদেশে ধর্মীয় অঙ্গনে যারা নেতৃত্ব দিয়ে গভীর প্রভাব রেখে গিয়েছেন তাদের অন্যতম শীর্ষ শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব তিনি। এরকম বড়মাপের ব্যক্তিত্বদের জীবনে সফর বা ভ্রমণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বহু জায়গায় যেতে হয় তাদের। বিশেষত যারা ইসলামের দাওয়াতের কাজ করেছেন তাদের জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। হাকিমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ. জনসাধারণের মাঝে একজন বিখ্যাত আলেম, মুফতি, সুফি ও লেখক হিসেবে সুপরিচিত। এছাড়াও তার আরেকটি পরিচয় আছে। সেটি হচ্ছে তিনি একজন সফল দায়ি। তার দাওয়াতি কার্যক্রমের সুবাদে তিনি চষে বেড়িয়েছে পুরো উপমহাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
এমনিতে হযরত হাকিমুল উম্মত রহ. কোন ভ্রমণপিয়াসু মানুষ ছিলেন না। একাকিত্ব ও নির্জনতা ছিল তার স্বভাবজাত। আল্লাহওয়ালা সুফি-সাধকরা সাধারণত নির্জনতাকেই ভালোবাসেন। থানবি রহ.-ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে তিনি শুধুমাত্র সুফি ছিলেন না; ছিলেন শরিয়তের একজন বিদগ্ধ আলেমও। ফলত তিনি সমাজের বাইরে থাকতে পারেননি। জনসাধারণের সংশোধনকল্পে তিনি নিজের সারা জীবন ব্যয় করেছেন।
তার জীবনিকার খাজা আযিযুল হাসান মাজযুব যথার্থ লিখেছেন, ‘স্বভাবগতভাবেই হযরত হাকিমুল উম্মত রহ. ছিলেন নির্জনতাপ্রিয় মানুষ। মানুষের ভীড় আর হুজুম ছিল তার খুবই অপছন্দের। সফরে নিজের মামুলাত আদায়ে সমস্যার পাশাপাশি সাক্ষাতপ্রত্যাশীদের ভীড়ে একাগ্রতাও নষ্ট হয়ে যেত। এ কারণে সবসময় তিনি সফরের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইতেন। কিন্তু শরঈ প্রয়োজনে যেমন হজ, ওমরা, দাওয়াহ ও উম্মাতের সংশোধন এবং অসুস্থদের দেখতে যাওয়া প্রবৃত্তি প্রয়োজনে শারীরিক মানসিক অনেক কষ্ট সহ্য করে কাছে-দূরে অনেক সফর করেছেন। এ সফরগুলোর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর বহুমুখী উপকার সাধিত হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের যেসব মুসলমানরা দূরত্বের কারণে খানকায় উপস্থিত হতে পারতো না, তারা এ উসিলায় সালাফে সালেহিনের একজন উপযুক্ত নমুনা ও সত্যিকার উত্তরাধিকারীকে কাছ থেকে দেখার, তার কাছ থেকে বিভিন্ন কিছু শেখার এবং তার সান্নিধ্য থেকে বহুমুখী কল্যাণ অর্জন করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছে।’
২
হাকিমুল উম্মত রাহ.-এর সফরগুলো হতো সাধারণত শিক্ষণীয় ও দাওয়াহনির্ভর। আলিম-ওলামা ও সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে সবার জন্য উপকারী ও কল্যাণময় বিষয় থাকত তার সফরে। কারণ তিনি কখনও উদ্দেশ্যহীন সফর করেননি। সাধারণত আমরা যারা ভ্রমণে বের হই তাদের অনেক কিছুই উদ্দেশ্য থাকে। বেশিরভাগ মানুষ ভ্রমণে বের হন নিছক বিনোদনের জন্য । বর্তমানে যারা দাওয়াতি সফরে যান, তারাও ফাঁক বের করে বিনোদনের কাজটি সেরে নেন। কিন্তু থানবি রহ.-এর সফর ছিল একেবারে নিখাদ দাওয়াতি ও ইসলাহি। সফরের প্রত্যেকটি ধাপে শরিয়তের বিভিন্ন বিধান, সামাজিক শিষ্টাচার কীভাবে তিনি পালন করেন তা ছিল শিক্ষণীয় বিষয়। সফরের সময়গুলোতে তিনি নিজে যেভাবে শরিয়তের নিয়ম-কানুনের প্রতি বিশেষভাবে যত্নশীল থাকতেন, তদ্রুপ নিজের সফরসঙ্গীদেরও রাখতেন কড়া পর্যবেক্ষণে।
তার কাছে সফরের আবেদন আসত খুব বেশি। কিন্তু খুব অল্প আবেদন তিনি মঞ্জুর করতেন। হযরত হাকিমুল উম্মত রহ. ছিলেন প্রচণ্ড নীতিবান মানুষ। সামান্যতম নীতিবিরোধী কাজ তিনি সহ্য করতেন না। ছোটখাটো ভুলও তার নজর এড়াত না। তার কড়া নীতির কারণে যে কেউ চাইলেই কিছু বলতে পারত না। তবু তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর আগ্রহের কমতি ছিল না। তার জীবনিকার খাজা আযিযুল হাসান লিখেছেন, তার কাছে যে পরিমাণ সফরের আবেদন আসত তার দশ শতাংশ গ্রহণ করলেও তিনি নিজের দেশে একদিনের জন্যও থাকার সুযোগ থাকত না। ৩৬৫ দিনই তাকে কাটাতে হতো আপন শহরের বাইরে। বেশিমাত্রায় পীড়াপিড়ি করলে বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে তারপর আবেদন মঞ্জুর করতেন। হযরত হাকিমুল উম্মত রহ. উপমহাদেশের প্রায় সবক’টি অঞ্চলেই সফর করেছিলেন। তবে বেশিরভাগ সফরই ছিল বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হায়দারাবাদ, বিহার ইত্যাদি প্রদেশে। বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়ও থানবি এসেছিলেন বাংলার নবাব সলিমুল্লাহ সাহেবের দাওয়াতে।
৩
হযরত হাকিমুল উম্মত রহ.-এর ঢাকা সফর বিভিন্ন কারণে ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে নবাব সলিমুল্লাহর ইসলামপ্রিয়তা এবং আলেমপ্রীতি ফুটে ওঠে। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও এ সফরের পূর্ণ বিবরণ পাইনি। তবে থানবির জীবনিকার খাজা আযীযুল হাসান সাহেব ‘আশরাফুস সাওয়ানেহ’ গ্রন্থে এর নাতিদীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। আমরা তার উক্ত গ্রন্থ থেকে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি।
সুলতানি ও মোঘল স্মৃতিধন্য ঢাকা প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী শহর। তখনকার মোঘলাই ঢাকা আজকের মতো অত জনবহুল ছিল না। অবশ্য ছিল না জনশূন্যও। নবাব সলিমুল্লাহ খান দাওয়াত করলেন আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট হযরত হাকিমুল উম্মত রহ.-কে। শুধু দাওয়াত না; একরকম পীড়াপিড়ি করলেন আসার জন্য। স্বাভাবিকভাবে আমাদের আকাবির আলেমগণ ক্ষমতাসীন লোকদের থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। থানবিও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু নবাব সলিমুল্লাহর মতো ইসলামপ্রিয় স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিদের দাওয়াত একেবারে ঠিকরে দেওয়ারও সুযোগ ছিল না। হযরত থানবি বরাবরের মত বেশ কড়া কড়া কিছু শর্তারোপ করলেন:
১. কোন প্রকার নগদ কিংবা অন্য কিছু হাদিয়া দেওয়া যাবে না।
২. আপনার নিজের সাক্ষাতের জন্য আলাদা একটি সময় নির্ধারণ করুন, যেখানে অন্য কেউ থাকতে পারবে না। যাতে কোন কৃত্রিমতা ছাড়াই মুক্ত মতবিনিময় করা যায়।
৩. আমার অবস্থানের জায়গা আপনার বিশেষ প্রাসাদের বাইরে এমন কোন জায়গায় হতে হবে, যেখানে সাধারণ মানুষ অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে।
৪. কোন বিশেষ বিষয়ে ওয়াজ/বক্তৃতা করার আবদার করা যাবে না।
নবাব সাহেব স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী সঠিক স্বভাবের অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। নাম আর কাজের মধ্যে ছিল না বৈপরিত্ব। ফলে তিনি সব শর্ত মঞ্জুর করে নিলেন। হযরত হাকিমুল উম্মত রহ.-ও সফরের জন্য আগ্রহী হলেন।
নবাব সাহেব চেয়েছিলেন, ভাইসরয়কে যেভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, হযরত হাকিমুল উম্মত রহ.-কেও ঠিক সেভাবে সংবর্ধনা দেবেন। যেমন প্লাটফর্মে মখমলের কার্পেট বিছিয়ে, হরেক রকমের আলোকসজ্জা করে হযরতকে বরণ করে নিবেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে নবাবের চাচার মারফত থানবি নবাবের ইচ্ছা সম্বন্ধে খবর পেয়ে যান। তখন তিনি নবাবকে পত্র লিখলেন জানালেন এটি শরিয়তবিরোধী কাজ। এরপর নবাব অনুমতি চাইলেন, আমি এক বিশাল দল নিয়ে আপনাকে সংবর্ধনা দিতে চাই, যেখানে সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ এবং শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন। থানবি বললেন, এ বিষয়টি আমার স্বভাববিরুদ্ধ। এরপর কোনরকম আয়োজন ছাড়াই স্টেশনে হাজির হয়েছিল ভক্তবৃন্দের বিশাল একটি দল। নবাব সলিমুল্লাহ সাহেব থানবিকে নিজের স্পেশাল গাড়িতে বসিয়ে নিজে আরেকটি গাড়িতে আরোহণ করলেন। কেউ কেউ জোরাজুরি করলে তিনি বললেন, এটা আদবের খেলাফ হবে। হযরত থানবি যতদিন অবস্থান করেছিলেন, চূড়ান্ত পর্যায়ের আদবের প্রতি লক্ষ্য রেখে তিনি হযরতের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসেননি। প্রতিবেলা নবাবের বাসা থেকে খাবার আসত। খোদ নবাব সাহেব নিজে দস্তরখানে খাবার পরিবেশন করতেন। স্বভাবের মধ্যে মিল থাকায় একপর্যায়ে থানবির সঙ্গে তার অকৃত্রিম সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। যেমন একবার দস্তরখানে হরেকরকমের খাবার পরিবেশন করতে করতে নবাব সাহেব বললেন, এটা আমার অমুক বিবি আপনার জন্য রান্না করেছেন। দুয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন, তরকারিটাকে কি বলে বলুন তো? থানবিও সঙ্গে সঙ্গে মজা করে বললেন, খেতে হলে কি নাম জানতে হবে? খাবারের যে স্বাদ তা তো খেলেই পাওয়া যাচ্ছে। এর জন্য তো আর খাবারটির পরিচয় জানতে হবে না। আর যদি আপনি মনে করেন, খাওয়ার জন্য সেটি চিনতে হবে, তবে আপনার খাবারের আমার কোন প্রয়োজন নেই। এরপর থেকে নবাব সাহেব নিজেই বিভিন্ন তরি-তরকারির পরিচয় তুলে ধরতেন।
হযরত হাকিমুল উম্মত রহ. নবাব সাহেবের ভদ্রতা ও মার্জিত আচরণ এবং সঠিক বোধশক্তির খুব প্রশংসা করতেন। বিভিন্ন সময় তার উন্নত চরিত্রের নানা ঘটনা বর্ণনা করতেন। এ সফরেই নবাব সলিমুল্লাহ খান থানবির কাছে আবেদন করলেন বাইআত হওয়ার। কিন্তু থানবি বাইয়াত করতে রাজি হলেন না। বললেন, এ জাতীয় ক্ষমতাসীন লোকদের বাইআত করে কোন লাভ নেই। কারণ মুরিদ হতে হলে এমন হতে হবে, যাকে প্রয়োজনে ও সংশোধনকল্পে একটু ধমক দেওয়া যায়, কড়া কথা বলা যায়। যাদেরকে খাতির করে চলতে হয় তাদেরকে তো আর ইসলাহ করা যায় না। এরপরও হযরত থানবির প্রতি নবাব সাহেবের ভক্তিশ্রদ্ধায় কোন হ্রাস ঘটেনি। নবাব সাহেব এরপরও বহুবার হযরতের সঙ্গে পত্রালাপ করেছেন। আমৃত্যু সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। পত্রে তিনি নিজের নাম লিখতেন, ‘আপনার মুরিদ সলিমুল্লাহ’।
এ ঘটনা থেকে একদিকে যেমন হযরত থানবির উন্নত ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় নবাবের সম্ভ্রান্ত চরিত্রের পরিচয়। এত বড় ক্ষমতাসীন লোককে বাগে পাওয়া সত্ত্বেও তিনি বাইআত করেননি। হাদিয়া না দেওয়ার শর্তে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। এসব বিষয় থেকে থানবির একটি নির্লোভ মনের উজ্জ্বল চিত্র ভেসে ওঠে। আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের কয়জন পীর এটা পারতেন। এ-ও জানা গেল, থানবি বাঙ্গালা মুলুকে পর্যন্ত কী পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশাপাশি আবহমান বাঙালী মুসলমান কত বেশী ধর্মপ্রাণ ছিলেন সে চিত্রও ফুটে ওঠে। বাঙ্গালা মুলুকেও ছিলেন থানবির বিশিষ্ট খলিফারা। তাদের মাধ্যমেও থানবির জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার-প্রসার ঘটেছে বিস্তৃত আকারে। বাংলাদেশের অন্যতম আধ্যাত্মিক প্রাণপুরুষ হযরত হাফেজ্জি হুজুর, সদর সাহেব খ্যাত হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি এবং কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা আতহার আলি রহ. প্রমুখ হযরত থানবির হাতে বাইআত হয়ে নিজেদের সংশোধনের সাধনা করেছিলেন। একপর্যায়ে তারা থানবির ইজাযতপ্রাপ্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তারা আত্মনিয়োগ করেন ইসলামের বহুমুখী সেবায়। তাদের হাত ধরে বাংলাদেশে ধর্মীয় কার্যক্রম ব্যাপক আকারে বিস্তৃতি লাভ করে। থানবির আরেক খলিফা মাওলানা আবরারুল হক হারদুয়ির বহু খলিফা বাংলাদেশে ধর্মীয় অঙ্গনে অবদান রেখে চলেছেন। আজকে আমরা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ইসলামের যে জাগরণ লক্ষ্য করি তাতে হযরত থানবির যে প্রচুর অবদান আছে তা বোধহয় কোন সচেতন মানুষ অস্বীকার করতে পারবে না।
লেখক: শিক্ষক ও এক্টিভিস্ট