বিষয়বস্তুতে চলুন

দুর্নীতির পথে/আজীবন ব্রহ্মচর্য্য

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ অধ্যায়

আজীবন ব্রহ্মচর্য্য

বিবাহের পূর্ব্ব এবং পরে সংযম রক্ষা করিতে বলিয়া, এবং আত্ম-সংযম অসম্ভব বা অনিষ্টকর নহে বরং ইহা সম্ভব এবং মন ও শরীরের পক্ষে হিতকর ইহা দেখার পর বুরো আজীবন ব্রহ্মচর্য্য সম্বন্ধে এক অধ্যায় লিখিয়াছেন। তাহার প্রথম প্যারাটি এই:—

 “কাম-বাসনার গোলামী হইতে মুক্ত বীরদের মধ্যে সর্ব্বপ্রথম সেই সব যুবক যুবতীর নাম লওয়া দরকার, যাঁহারা কোনো মহান্ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আজীবন অবিবাহিত থাকিয়া ব্রহ্মচর্য্য পালন করা স্থির করিয়াছেন। তাঁহাদের এই দৃঢ় সংকল্পের ভিন্ন ভিন্ন কারণ আছে। কেহ অসহায় পিতামাতার সেবা করা কর্তব্য মনে করেন, কেহ মাতৃপিতৃহীন ছোট ভাইভগ্নীর মাতাপিতার স্থান গ্রহণ করেন, কেহ জ্ঞানের সাধনায় জীবন উৎসর্গ করেন, কেহ দরিদ্র অথবা রোগীর সেবায়, কেহ ধর্ম্ম বা নীতিশিক্ষা কার্য্যে আপনাকে নিয়োজিত করিতে চান। এই সংকল্প পালন করিতে গিয়া কাহাকে কাহাকেও পাশববৃত্তির সহিত ভয়ানক যুদ্ধ করিতে হয়, এবং ভাগ্যবশে কেহ কেহ ইন্দ্রিয় দ্বারা একরূপ প্রলুব্ধই হন না। তাঁহারা মনে মনে নিজের কাছে অথবা ভগবানের কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, যে সংকল্প তাঁহারা করিয়াছেন তাহা ত্যাগ করিবেন না এবং বিবাহের চিন্তা করা তাঁহাদের পক্ষে ব্যভিচার সদৃশ। অবস্থা বিশেষে বিবাহ করা অবশ্য কর্তব্য হইলেও, মহৎ ও উদার উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হইয়া বিবাহ না করার সংকল্পও কোনো কোনো স্থলে ন্যায়সঙ্গত। প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী মাইকেল এঞ্জেলোকে কেহ বিবাহ করিতে বলিলে তিনি কহিয়াছিলেন, “আমার পত্নী চিত্রবিদ্যা বড় হিংসুটে; তিনি সতীন বরদাস্ত করবেন না।”

 যাঁহারা আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করিয়াছেন, এইরূপ সকল প্রকার ইউরোপীয় বন্ধুর অভিজ্ঞতার বিবরণ বুরে সাহেব তাঁহার পুস্তকে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তাহাদের কথা উদ্ধৃত করিয়া আমি উপরের উক্তি সমর্থন করিতে পারি। শুধু ভারতেই শিশুকাল হইতে আমাদিগকে বিবাহের কথা শুনান হয়। বালকদের বিবাহ দেওয়া এবং তাহাদের জন্য যথেষ্ট অর্থ সম্পদ রাখিয়া যাওয়া ভিন্ন মাতাপিতার অন্য চিন্তা অন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা নাই। প্রথমটি অকালে বুদ্ধি ও শরীর ধ্বংস করে, দ্বিতীয়টি অলসতার প্রশ্রয় দেয় এবং অনেক সময় লোককে পরগাছার ন্যায় করিয়া তোলে। ব্রহ্মচর্য্য ও দারিদ্র-ব্রতের কঠোরতাকে আমরা অতিরঞ্জিত করিয়া থাকি এবং বলি ইহা পালন করিতে হইলে অসাধারণ শক্তির দরকার। এ দুটি জিনিষ আমরা মহাত্মা ও যোগীর জন্য রাখিয়া দি; একথা আমরা ভুলিয়া যাই, যেখানে সাধারণ লোকের অবস্থা হীন সেখানে সাচ্চা মহাত্মা ও যোগীর উদ্ভব সম্ভব নহে। সদাচারের গতি কচ্ছপের গতির ন্যায় ধীর অথচ অবাধ, কিন্তু দুরাচার শশকের ন্যায় দ্রুত চলে। এই হিসাবে পশ্চিমের ব্যভিচারের সওদা বিদ্যুৎগতিতে আমাদের নিকট আসে ও আপনার মনোমমাহিনী চাকচিক্যের দ্বারা আমাদের চোখ ঝলসাইয়া দেয় এবং আমরা সত্যকে ভুলিয়া যাই। প্রতি মুহূর্ত্তে পশ্চিম হইতে যে তার আসিতেছে, প্রতিদিন পাশ্চাত্য দেশের মাল বোঝাই হইয়া যে জাহাজ এখানে পৌছিতেছে, এবং এইরূপে যে চটকদার জিনিষ আসিতেছে, তাহা দেখিয়া ব্রহ্মচর্য্যব্রত পর্যন্ত গ্রহণ করিতে আমরা লজ্জিত হইতেছি এবং দারিদ্র্য-ব্রতকে পাপ বলিয়া ঘোষণা করিতে প্রস্তুত হইয়াছি। পরন্তু ভারতবর্ষে আমরা পশ্চিমের যে রূপ দেখিতেছি, পশ্চিম সম্পূর্ণরূপে তাহা নহে। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গগণ সেখানকার ভারতীয় বাসিন্দাদিগকে দেখিয়া, সমস্ত ভারতবাসীর চরিত্র সম্বন্ধে একটা ধারণা পোষণ করিয়া যেমন ভুল করে, সেইরূপ ইউরোপ হইতে প্রতিদিন যে লোকজন ও মালপত্রাদি আসিতেছে, তাহা দেখিয়া পাশ্চাত্য দেশ সম্বন্ধে ধারণা করা আমাদের ভুল হইবে। যাহারা এই ভ্রমের পরদা সরাইয়া ভিতরের বস্তু দেখিতে সক্ষম, তাহারা দেখিতে পাইবেন যে, পশ্চিমেও পবিত্রতা এবং শক্তির একটি ক্ষুদ্র অথচ অফুরন্ত উৎস আছে। ইউরোপের মহা মরুভূমিতেও এরূপ সব ঝরণা আছে, যেখানে যে-কেহ ইচ্ছা করিলে সর্বাপেক্ষা পবিত্র জীবনবারি পান করিয়া তৃপ্ত হইতে পারে। সেখানকার শত শত স্ত্রীপুরুষ স্বেচ্ছায় ব্রহ্মচর্য ও দারিদ্র্য-ব্রত গ্রহণ করিয়া থাকেন, এ জন্য কেহ ভুল করিয়াও গর্ব অথবা হৈ চৈ করেন না। তাঁহারা নম্রতার সহিত স্ব-জন অথবা দেশসেবার জন্য ইহাতে ব্রতী হইয়া থাকেন। আমরা বলিয়া থাকি যে, ধর্ম্মের সহিত সংসারের সাধারণ কাজের কোনো সম্বন্ধ নাই এবং যে সব যোগী হিমালয় পর্ব্বতস্থ বন অথবা গুহায় একান্তবাস করিতেছেন ধর্ম্ম শুধু তাঁহাদের জন্য। যে আধ্যাত্মিকতা লোকের দৈনন্দিন জীবনের সহিত সম্পর্কশূন্য, যার প্রভাব সংসারের উপর পড়ে না, তাহা আকাশ কুসুম ভিন্ন আর কিছুই নহে। সপ্তাহে সপ্তাহে যাহাদের জন্য ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’ লেখা হয়, সেই সব যুবক যুবতী জানিয়া রাখুন যে, যদি তাহারা তাহাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পবিত্র করিতে এবং দুর্ব্বলতা পরিহার করিতে চান, তবে ব্রহ্মচর্য্য ব্রত পালন করা তাহাদের কর্ত্তব্য; তাহাদের ইহাও জানা দরকার, তাহারা যেরূপ শুনিয়া আসিতেছেন, ব্রহ্মচর্য্য পালন করা তত কঠিন নহে॥  বুরো সাহেব আরও বলেন, “বর্ত্তমান সমাজ-বিজ্ঞান যে পরিমাণে আমাদের নৈতিক অভিব্যক্তির অনুসরণ করিবে এবং যত গভীরভাবে ও শৃঙ্খলার সহিত আমরা সমাজের বাস্তব সমস্যা আলোচনা করিতে পারিব, সমস্ত ইন্দ্রিয়সংযমের কাজে ব্রহ্মচর্য্যের সহায়তার মূল্য আমরা সেই পরিমাণে উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইব। বিবাহ করা আবশ্যক মানিয়া লইলেও, সকলে বিবাহ করিতে পারে না, অথবা সকলের পক্ষে ইহা আবশ্যক কিংবা উচিত বলা যায় না। যাহাদের কথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে তাহারা ভিন্ন আরও তিন শ্রেণীর লোক আছে, যাহাদের পক্ষে ব্রহ্মচর্য্য পালন করা ভিন্ন অন্য কোনো পথ নাই; (১) যে সব যুবক-যুবতী অর্থনৈতিক কারণে বিবাহ পিছাইয়া দেওয়া উচিত মনে করে; (২) যাহাদের উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী জোটে না; (৩) যে সব লোকের এমন কোন রোগ আছে যাহা সন্তান-সন্ততিতে সংক্রামিত হইবার আশঙ্কা আছে, অথবা যাহারা অন্য কোনো কারণে বিবাহের চিন্তা বিলকুল ত্যাগ করিযাছে। কোনো মহৎ কার্য্য বা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে সব স্ত্রী-পুরুষ মানসিক ও শারীরিক শক্তির পূর্ণ অধিকারী এবং কখনও কখনও যথেষ্ট ধনসম্পদের মালিক হইয়াও আজীবন ব্রহ্মচর্য্য পালন করেন, তাঁহাদের দৃষ্টান্তে যাহারা বাধ্য হইয়া ব্রহ্মচর্য্য পালন করেন, তাহাদের ব্রতপালনে অনেক সাহায্য হয়। স্বেচ্ছা-পূর্ব্বক যাঁহারা ব্রহ্মচর্য্য ব্রত ধারণ করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট ব্রহ্মচারীর জীবন অসম্পূর্ণ মনে হয় না, বরং ইহাকে তাঁহারা মহৎ ও পরমানন্দপূর্ণ মনে করেন। তাঁহাদের ব্রতপালন দেখিয়া অবিবাহিত এবং বিবাহিত উভয় প্রকার ব্রহ্মচারীর নিজেদের ব্রতপালনে উৎসাহ আসে। তাঁহারা ইহাদের পথ-প্রদর্শক।

 বিবাহ করার যোগ্য বয়স যাহাদের হয় নাই, আজীবন ব্রহ্মচর্য্য পালন করার দৃষ্টান্ত দেখিয়া, তাহারা যৌবনকাল সংযতভাবে কাটান সম্ভব মনে করিবে, বিবাহিতেরাও ইহা হইতে এই শিক্ষা পাইবে যে, যতই সঙ্গত হউক না কেন, তাহাদের স্বার্থচিন্তা যেন কখনও নৈতিক মহত্ব ও প্রকৃত প্রেমের উচ্চতর আহ্বানকে ছাপাইয়া না উঠে।

 ফোরষ্টার বলেন, “ব্রহ্মচর্য্য-ব্রত বিবাহ-প্রথার মূল্য কমায় না; বরং ইহা দাম্পত্যবন্ধনের পবিত্রতা বৃদ্ধির সাহায্য করে; কারণ ইহা স্পষ্টভাবে দেখায় যে, প্রকৃতির তাড়না সত্ত্বে মানুষ ইন্দ্রিয়ের অধীনতা হইতে মুক্ত হইতে পারে। সাময়িক খেয়াল ও ইন্দ্রিয়ের তাড়নার সময় ব্রহ্মচর্য্য-ব্রত বিবেকের ন্যায় কাজ করে। ব্রহ্মচর্য্য এই হিসাবে বিবাহিতের পক্ষে কবচ সদৃশ যে, ইহার কল্যাণে বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষে বুঝিতে পারে, তাহারা একে অপরের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সাধন মাত্র নহে এবং প্রলোভন সত্ত্বে তাহারা ইন্দ্রিয়ের উপর প্রভুত্ব করিতে সক্ষম। যাহারা চিরকৌমার্যকে অস্বাভাবিক ও অসম্ভব বলিয়া তাচ্ছিল্যের সহিত উড়াইয়া দিতে চায়, তাহারা জানে না তাহারা কি করিতেছে। তাহারা দেখিতে পাইতেছে না, যে চিন্তার ধারা অনুসারে তাহারা আলোচনা করিতেছে, কঠোর তর্কশাস্ত্র অনুসারে সেই পথে চলিলে তাহাদিগকে বেশ্যাবৃত্তি ও বহুবিবাহ সমর্থন করিতে হইবে। বিষয়বাসনার বেগ যদি অদম্যই হয়, তবে বিবাহিত লোকেই বা কিরূপে পবিত্রজীবন যাপন করিবে? তাহারা ভুলিয়া যায় যে, রোগ বা অন্য কোনো কারণে কখনও কখনও দম্পতির একজনের অক্ষমতার জন্য অপরের আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করা অনিবার্য্য হইয়া পড়ে। কেবল এই কারণেই ব্রহ্মচর্য্যের যত মহিমা আমরা স্বীকার করিব, এক-পত্নী-ব্রতের আদর্শও তত উঁচুতে স্থাপন করা হইবে।