অ্যামিকাস কিউরি
অ্যামিকাস কিউরি (লাতিন: Amicus Curiae, অর্থাৎ 'আদালতের বন্ধু') একটি ব্যক্তি বা সংস্থা, যারা কোনো মামলার পক্ষ নয়, কিন্তু মামলায় নিজেদের মতামত বা পরামর্শ প্রদান করে। সাধারণত, এই ব্যক্তি বা সংস্থা মামলা সম্পর্কিত কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত বা তথ্য প্রদান করে, যা আদালতের ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়ক হতে পারে। তারা আদালতের অনুমতি নিয়ে মামলা সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে প্রভাবশালী প্রমাণ বা যুক্তি উপস্থাপন করতে পারে।[১][২][৩]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]প্রাচীন রোমে এই ধারণার উদ্ভব ঘটে, যেখানে বিচার প্রক্রিয়ায় স্বাধীন পরামর্শ প্রদান করা হতো। প্রাথমিকভাবে, রোমান বিচারব্যবস্থায় অ্যামিকাস কিউরি বিচারকদের সহযোগিতা করতো জটিল আইনি প্রশ্নের সমাধানে। আধুনিক সময়ে, অ্যামিকাস কিউরি ধারাটি প্রধানত ইংলিশ কমন ল' ব্যবস্থায় বিকশিত হয় এবং বর্তমানে এটি বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[৪][৫]
ভূমিকা ও গুরুত্ব
[সম্পাদনা]অ্যামিকাস কিউরি সাধারণত কোনো মামলা সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ তথ্য বা বিশ্লেষণ আদালতে উপস্থাপন করে, যা মামলার মূল পক্ষের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। এর ফলে, আদালত সাধারণ জ্ঞানের বাইরে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের ভিত্তিতে ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।
এটি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ, আইনি বিশ্লেষণ, বা আদালতের অধীন কোনো বিশেষ ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের মতামত সরবরাহ করে, যা বিচারকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। অ্যামিকাস কিউরি আদালতকে একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাসঙ্গিক তথ্য ও যুক্তি প্রদান করতে পারে, যা মামলার পক্ষগণ সরাসরি তুলে ধরে না। বিশেষ করে, জটিল সাংবিধানিক ইস্যু, মানবাধিকার বিষয়ক মামলা, বা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অ্যামিকাস কিউরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় অ্যামিকাস কিউরি সমাজের প্রভাবশালী সমস্যা সম্পর্কে আদালতকে আলোকপাত করে, যেমন পরিবেশ রক্ষা, নাগরিক অধিকার, এবং বৈষম্য বিরোধী নীতিমালা। এভাবে, এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং বিচারিক প্রক্রিয়াকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো আইন বা সাংবিধানিক বিষয় অত্যন্ত জটিল এবং আদালতের গভীর গবেষণার প্রয়োজন হয়, তখন অ্যামিকাস কিউরি ওই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারে।[৬]
আদালতে প্রয়োগ
[সম্পাদনা]১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে অ্যামিকাস কিউরি খুবই সাধারণ একটি ধারণা। বিশেষ করে বিভিন্ন বৃহৎ মামলায়, যেমন নাগরিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, সংস্থা বা এনজিও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে অংশগ্রহণ করে।
২. ভারত: ভারতের উচ্চ আদালতেও অ্যামিকাস কিউরির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কয়েকটি মামলায়, বিশেষ করে সংবিধান ও মানবাধিকারের মতো জটিল বিষয়ে, অ্যামিকাস কিউরি আদালতকে সহায়তা করে।
৩. বাংলাদেশ: বাংলাদেশে অ্যামিকাস কিউরির ধারণা তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা আদালতের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে থাকেন। সাধারণত উচ্চ আদালত, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট, বিভিন্ন সংবিধানিক ও মানবাধিকার বিষয়ক মামলায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শের জন্য অ্যামিকাস কিউরিকে আমন্ত্রণ জানায়। মানবাধিকার, পরিবেশ আইন, নির্বাচন ও সংবিধান সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দেশের নামকরা আইনজীবী বা বিশেষজ্ঞরা আদালতে তাদের মতামত উপস্থাপন করেন। যেমন, রানা প্লাজা ধসে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিরাপত্তার ইস্যুতে বা সাভার ট্রাজেডির পর শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কিত মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বিশেষজ্ঞরা আদালতকে সাহায্য করেছেন। বাংলাদেশে অ্যামিকাস কিউরির ব্যবহার আদালতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।[৭][৮][৯]
অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ভূমিকা পালনকারীরা:
[সম্পাদনা]- আইনি পেশাজীবী
- একাডেমিক বিশেষজ্ঞ
- এনজিও বা মানবাধিকার সংস্থা
- বেসরকারি সংস্থা (NGOs)
উদাহরণ:
[সম্পাদনা]১. ব্রাউন বনাম বোর্ড অব এডুকেশন (১৯৫৪): এই মামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে বর্ণবৈষম্যের অবসানের পক্ষে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তাদের মতামত প্রদান করেছিল।
২. অবসরপ্রাপ্ত বিচারক দ্বারা প্রাপ্ত পরামর্শ: অনেক সময় অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ করা হয়, বিশেষ করে সেই সব মামলায় যেখানে সংবিধান সংশ্লিষ্ট জটিল প্রশ্ন রয়েছে।
সমালোচনা
[সম্পাদনা]কিছু সমালোচক মনে করেন যে অ্যামিকাস কিউরির ভূমিকায় থাকা ব্যক্তি বা সংস্থাগুলো আদালতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া, তারা বিচারকদের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করতে পারে, যদি সেই পরামর্শ দেওয়ার উদ্দেশ্য পক্ষপাতমূলক হয়।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Amicus curiae"। Wikipedia। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৪।
- ↑ "Amicus Curiae Legal Definition"। The Free Dictionary। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৪।
- ↑ "Amicus Curiae"। Britannica। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৪।
- ↑ "Amicus Curiae"। The Free Dictionary। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-১১।
- ↑ "Amicus Curiae"। Encyclopaedia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-১১।
- ↑ "Amicus Curiae"। Cornell Law School Legal Information Institute। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-১১।
- ↑ "Amicus Curiae in Bangladesh"। BD Law Digest। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৪।
- ↑ "Role of Amicus Curiae in Bangladesh Judicial System"। দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৪।
- ↑ "Amicus Curiae's Role in Constitutional Matters"। New Age Bangladesh। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৪।