অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞান
অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞান বা অ্যাটোসেকেন্ড বিজ্ঞান বিজ্ঞানের একটি অত্যাধুনিক বিশেষায়িত গবেষণাক্ষেত্র যেখানে অ্যাটোসেকেন্ড নামক সময়ের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি এককে পরিমাপকৃত সময়-পরিসরের ঘটনাবলী নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা সম্পাদন করা হয়। এক অ্যাটোসেকেন্ড হল এক সেকেন্ডের দশ হাজার কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ কিংবা এক ন্যানোসেকেন্ডের একশত কোটি ভাগের এক ভাগ (১×১০−১৮ সেকেন্ড)। এই গবেষণা ক্ষেত্রটিতে চোখের পলকে চটজলদি আলোকচিত্রগ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা পরমাণু ও অণুর অভ্যন্তরে অতিক্ষুদ্র ইলেকট্রন কণাগুলির অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত গতিবিধি অধ্যয়ন করতে পারেন।[১] অতিদ্রুত লেজার প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে এই ক্ষেত্রটির উদয় হয়। এ কাজটি করার জন্য বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত শক্তিশালী লেজার রশ্মি ব্যবহার করে অতি-হ্রস্ব কিছু আলোক স্পন্দন সৃষ্টি করেন, যাদেরকে "অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন" বলে। এই স্পন্দনগুলি মূলত উচ্চশক্তিবিশিষ্ট ফোটন কণাসমূহের অবিশ্বাস্যরকম হ্রস্ব ঝলক, যেগুলিকে অত্যন্ত দ্রুত কপাট-গতিবিশিষ্ট (শাটার স্পিড) অর্থাৎ অত্যন্ত হ্রস্ব আলোকসম্পাতকালবিশিষ্ট আলোকচিত্রগ্রাহক যন্ত্র (ক্যামেরা) হিসেবে কল্পনা করা যায়। তীব্র লেজার রশ্মির সাথে পরমাণু বা অণুর আন্তঃক্রিয়ার ফলে ঐ লেজার রশ্মির মূল কম্পাংকের অত্যন্ত উচ্চ পূর্ণগুণিতক কম্পাংকের উচ্চশক্তিবিশিষ্ট লেজার রশ্মির সৃষ্টি হয়, যেগুলি চরম অতিবেগুনি বা কোমল রঞ্জনরশ্মি পরিসরের মধ্যে পড়তে পারে। এই ব্যাপারটিকে উচ্চবর্গীয় পূর্ণগুণিতক উৎপাদন (High harmonic generation) বলে। অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞানে প্রধানত এই উচ্চবর্গীয় পূর্ণগুণিতক উৎপাদন পদ্ধতিটিকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চরম অতিবেগুনি বা কোমল রঞ্জনরশ্মির অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন সৃষ্টি করা হয়। এই স্পন্দনগুলির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনগুলি অত্যন্ত দ্রুতগতির যেসব প্রক্রিয়ায় পরমাণু থেকে মুক্তি লাভ করে (ইলেকট্রনের আয়নীভবন), আবার কীভাবে লেজাররশ্মির প্রভাবে মাতৃ-পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় (ইলেকট্রন পুনঃসংঘর্ষ) ও জটিল কোয়ান্টাম বলবৈজ্ঞানিক আন্তঃক্রিয়ার জন্ম দেয়, এই ব্যাপারগুলি অ্যাটোসেকেন্ড মাপনীতে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন করেন, এমনকি তারা অতিদ্রুত ইলেকট্রনের গতিবিধিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশগুলি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানে বিপ্লব সাধন করেছে ও ক্ষুদ্রতম মাপনীতে ইলেকট্রনসমূহের কোয়ান্টাম বলবৈজ্ঞানিক রহস্যময় আচরণের উপরে মৌলিক অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেছে, যা অতীতে মানুষের সাধ্যাতীত ছিল। ভের্নার হাইজেনবের্গ ১৯২৫ সালে বলেছিলেন যে পরমাণুর অভ্যন্তরের বিশ্ব অবলোকন করা সম্ভব নয়। অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞান সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। এটি অভূতপূর্ব সূক্ষ্মতার সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়াতে অণু-পরমাণুসমূহের গতিবিধি অধ্যয়নের সুযোগ করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে নতুন নতুন উপাদান পদার্থ তৈরি, কঠিন পদার্থে ইলেকট্রনের গতিবিধি অধ্যয়ন, অ্যাটোসেকেন্ড বর্ণালীবীক্ষণসহ (যা অতিদ্রুত চিত্রণ ও রোগনির্ণয়ে কাজে লাগবে) অন্যান্য নতুন প্রযুক্তির বিকাশ ত্বরান্বিতকরণে অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ রয়েছে। এমনকি কোনও কোনও বিজ্ঞানীর মতে দূরবর্তী ভবিষ্যতে অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞানের সাথে কোয়ান্টাম আলোকবিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে আন্তঃশাস্ত্রীয় গবেষণার মাধ্যমে কোয়ান্টাম তথ্যবিজ্ঞানে বিপ্লবের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
২০২২ সালে আন লুইলিয়ে, পল কর্কাম ও ফেরেনৎস ক্রাউস অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞান ও অতিদ্রুত লেজার বিজ্ঞানে অবদানের জন্য ওলফ পুরস্কার লাভ করেন এবং এর এক বছর পরেই ২০২৩ সালে আন লুইলিয়ে, ফেরেনৎস ক্রাউস ও পিয়ের আগোস্তিনি অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন নিয়ে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি বিকাশের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Davide Castelvecchi; Katharine Sanderson (৩ অক্টোবর ২০২৩)। "Physicists who built ultrafast 'attosecond' lasers win Nobel Prize"। Nature.com। সংগ্রহের তারিখ ৩ অক্টোবর ২০২৩।