বিষয়বস্তুতে চলুন

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে পুনর্নির্দেশিত)

প্রফুল্লচন্দ্র রায়

জন্ম
প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

২ আগস্ট, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ
মৃত্যু১৬ জুন ১৯৪৪(1944-06-16) (বয়স ৮২)
জাতীয়তাবাঙালি
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তনবিদ্যাসাগর কলেজ
প্রেসিডেন্সি কলেজ
কলকাতা
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচিতির কারণভারতীয় রসায়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠাতা; ভারতীয় রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠাতা
পুরস্কার
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্র
প্রতিষ্ঠানসমূহ
অভিসন্দর্ভের শিরোনামConjugated Sulphates of the Copper-Magnesium Group: A Study of Isomorphous Mixtures and Molecular Combinations (১৮৮৭)
ডক্টরাল উপদেষ্টাআলেকজান্ডার ক্রুম ব্রাউন
উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীসত্যেন্দ্রনাথ বসু
মেঘনাদ সাহা
জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জী
জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ
স্বাক্ষর

আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সিআইই, এএনআই, এফআরএএসবি, এফআইএস, এফসিএস (যিনি পি সি রায় নামেও পরিচিত; ২ আগস্ট ১৮৬১ - ১৬ জুন ১৯৪৪)[] ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, শিক্ষক, দার্শনিককবি। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কারি (I) নাইট্রেটের আবিষ্কারক। দেশি শিল্পায়ন উদ্যোক্তাও ছিলেন । তিনি ভারতের প্রথম শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্থপয়িতা। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেন।তার জন্ম অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলায় (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত)। তিনি বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসুর সহকর্মী ছিলেন।

প্রারম্ভিক জীবন

[সম্পাদনা]

প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তৎকালীন যশোর জেলার (পরবর্তীকালে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলা) কপোতাক্ষী নদী তীরে অবস্থিত রাড়ুলি-কাটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা তখন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) পূর্ব অংশের অন্তর্গত ছিল।[] তিনি ছিলেন ভুবনমোহিনী দেবী ও হরিশচন্দ্র রায়ের পুত্র। হরিশচন্দ্র রায় স্থানীয় জমিদার ছিলেন।[] বনেদি পরিবারের সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র ছেলেবেলা থেকেই সব বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় এবং প্রত্যুৎপন্নমতি ছিলেন।

তার পড়াশোনা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশয় রোগের কারণে তার পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যান। গ্রামে থাকার এই সময়টা তার জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। বাবার গ্রন্থাগারে প্রচুর বই পান তিনি এবং বইপাঠ তার জ্ঞানমানসের বিকাশসাধনে প্রভূত সহযোগিতা করে।

শিক্ষাজীবন

[সম্পাদনা]

১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্লচন্দ্র কলকাতায় পুনরায় ফিরে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্কুল ফাইনাল তথা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে কলেজ ফাইনাল তথা এফ এ পরীক্ষায় (ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি) দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সী থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান।[]

পরবর্তীকালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়েই ডি এসসি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তার সেই গবেষণার বিষয় ছিল কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণির সম্মিলিত সালফেটের সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ (ইংরেজি: Conjugated Sulphates of Copper Magnesium Group: A Study of Isomorphous Mixtures and Molecular Combination)। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং পিএইচডিডিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। এমনকি তার এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাকে হোপ প্রাইজে ভূষিত করা হয়। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে (India Before and After the Sepoy Mutiny) এবং ভারত বিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডযুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন।

কর্মজীবন

[সম্পাদনা]

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। বেতন পেতেন মাসে ২৫০ টাকা। প্রায় ২৪ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন।[]

পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তার নাস্তার দাম তৎকালীন ১ টাকার বেশি হলে "তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন"।[] নিজের জন্য তিনি মাসিক ৪০ টাকা রাখতেন। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি নিজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা দান করেন।[] অধ্যাপনায় তিনি একমাত্র বাংলা ব্যবহার করতেন।[]


অধ্যাপনাকালে তার প্রিয় বিষয় রসায়ন নিয়ে তিনি নিত্য নতুন অনেক গবেষণাও চালিয়ে যান।[] বাঙালিদের ব্যবসায় অনাগ্রহ ও হীনমন্যতা পর্যবেক্ষণে ১৮৯২ সালে, ৭০০ টাকা বিনিয়োগে ও নিজ উদ্যোগে, নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন[] এবং পরবর্তীকালে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন এর নতুন নাম রাখা হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড

খুলনা টেক্সটাইল মিলও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

অবদান

[সম্পাদনা]
  • নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তিনি তার গবেষণাকর্ম আরম্ভ করেন। তার এই গবেষণাস্থল থেকেই পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানার সৃষ্টি হয় যা ভারতবর্ষের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়নে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
  • ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মার্কারি (I) নাইট্রেট (মারকিউরাস নাইট্রাইট) [Hg2(NO2)2] আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।
  • সমবায়ের পুরোধা স্যার পিসি রায় ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে নিজ জন্মভূমিতে একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী পি সি রায় পিতার নামে আর,কে,বি,কে হরিশ্চন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
  • বাগেরহাট জেলায় ১৯১৮ সালে তিনি পি.সি কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজ বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে বিশাল ভূমিকা রাখছে।

সম্মাননা

[সম্পাদনা]

ব্যক্তি হিসেবে আচার্য

[সম্পাদনা]

দেশপ্রেম

[সম্পাদনা]

আচার্য দেবের দেশপ্রেম তাকে ইউরোপে থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। দেশে এসেও তিনি তার সেই স্বদেশপ্রীতির পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ক্লাসে বাংলায় লেকচার দিতেন। বাংলা ভাষা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে ছিল। তার বাচনভঙ্গী ছিল অসাধারণ যার দ্বারা তিনি ছাত্রদের মন জয় করে নিতেন খুব সহজেই। তিনি সকল ক্ষেত্রেই ছিলেন উদারপন্থী।

গ্রন্থাবলি

[সম্পাদনা]
  • India Before and After the Sepoy Mutiny (ভারত : সিপাহী বিদ্রোহের আগে এবং পরে)
  • সরল প্রাণিবিজ্ঞান, বাঙ্গালী মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার
  • হিন্দু রসায়নী বিদ্যা
  • মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১৪৫ টি
  • Life and experience of a Bengali chemist

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]
  • আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জীবন ও সাধনা: অধ্যাপক এম কে আলী।
  • জীবনস্মৃতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়: জয়ন্ত কুমার ঘোষ।
  • আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়: শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু।
  • টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয় (জনকণ্ঠের সাপ্তাহিক প্রতিবেদন - ০৫ মে, ২০০২): অমল সাহা।
  • আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় উপমহাদেশে রসায়নশাস্ত্রের পথিকৃৎ (মাসিক সায়েন্স ওয়ার্ল্ড এর নিবন্ধ) - সুব্রত দাশ সোনা; বর্ষ ৫, সংখ্যা ৫৬, আগস্ট ২০০৬।

পাদটীকা

[সম্পাদনা]
  1. Prior to 1970, the Indian National Science Academy was named the "National Institute of Sciences of India", and its fellows bore the post-nominal "FNI". The post-nominal became "FNA" in 1970 when the association adopted its present name.

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "Proceedings of the Chemical Society"। Proceedings of the Chemical Society। 18.254: 160। ১৯০২। 
  2. "Obituary: Sir Prafulla Chandra Ray"। Journal of the Indian Chemical SocietyXXI: 253–260। ১৯৪৪। 
  3. {{বই উদ্ধৃতি=আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় | লেখক=জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত | শিরোনাম=বাল্যজীবন | প্রকাশক=ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া | আইএসবিএন=978-81-237-5645-5 | বছর=২০১১ | পাতা= ৩
  4. "রায়, প্রফুল্লচন্দ্র" 
  5. বই উদ্ধৃতি=আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় | লেখক=জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত | শিরোনাম=ছাত্র জীবন | প্রকাশক=ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া| আইএসবিএন=978-81-237-5645-5 | বছর=২০১১ | পাতা= ১৫-১৮
  6. বই উদ্ধৃতি=আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। | লেখক= জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত | শিরোনাম=রসায়নবিদের জীবন | প্রকাশক=ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া | আইএসবিএন=978-81-237-5645-5 | বছর=২০১১ | পাতা=২৫
  7. ইশতিয়াক, আহমাদ (২০২১-০৮-০২)। "আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়: মানবদরদী এক অনন্য মনীষী"The Daily Star Bangla। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-০৩