হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়

ভারতীয় সাংবাদিক

হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় (ইংরেজি: Harish Chandra Mukherjee) (জন্ম: ২৪ জুলাই ১৮২৪ (১২৩১ বঙ্গাব্দ) - মৃত্যু: ১৬ জুন ১৮৬১) একজন সাংবাদিক এবং সমাজসেবক। তিনি তার হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার মাধ্যমে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা সবার কাছে তুলে ধরেন।

হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়
জন্ম২৪ জুলাই, ১৮২৪
মৃত্যু১৬ জুন ১৮৬১
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়
পরিচিতির কারণসাংবাদিক ও সমাজসেবক

পরিবার

সম্পাদনা

হরিশ্চন্দ্রের জন্ম হয় বর্তমান কলকাতা শহরের ভবানীপুরে। সেই সময় ভবানীপুর কলকাতার অংশ বলে বিবেচিত হত না। তার পিতার নাম ছিল রামধন মুখোপাধ্যায়। রামধন রাঢ়ী শ্রেণিভুক্ত ফুলিয়া মেলের একজন কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। রামধনের বাড়ি ছিল বর্তমান বর্ধমান জেলার শ্রীধরপুর গ্রামে। রামধনের চার স্ত্রীর মধ্যে হরিশ্চন্দ্রের মা রুক্মিণী ছিলেন সবচেয়ে ছোট। হরিশ্চন্দ্র তার মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। তার এক দাদা ছিলেন হারাণচন্দ্র। হরিশ্চন্দ্রের জন্মের ছয়মাসের মধ্যেই তার পিতা রামধন মারা যান। হরিশ্চন্দ্রের মা রুক্মিনীদেবী কখনও স্বামীর গৃহে থাকেননি। তিনি তার মাতামহের বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই হারাণচন্দ্র এবং হরিশ্চন্দ্রের জন্ম হয়। হরিশ্চন্দ্রের ছোটবেলা অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছিল।

স্কুলে পড়ার সময়েই হরিশ্চন্দ্রকে মায়ের অনুরোধে বিয়ে করতে হয়েছিল। স্ত্রী ছিলেন মোক্ষদা সুন্দরী, উত্তরপাড়ার গোবিন্দচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা। মোক্ষদা সুন্দরীর গর্ভে হরিশ্চন্দ্রের দুটি সন্তান হয়েছিল। প্রথমটি মেয়ে যার জন্মের কয়েকদিন পরই মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় সন্তান হয় একটি ছেলে। ছেলেটি জন্মের ১৫ দিনের মধ্যেই মোক্ষদা সুন্দরীর মৃত্যু হয়। শিশুপুত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হরিশ্চন্দ্র দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ভগবতী। ভগবতী দরিদ্র পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তিনি সুন্দরী ছিলেন না এবং শিক্ষাদীক্ষাও বিশেষ ছিল না। যে পুত্রসন্তানটিকে দেখাশোনা করবার জন্য হরিশ্চন্দ্র দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সে মাত্র তিন বছর বয়েসে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানের মৃত্যূতে হরিশ্চন্দ্র মানসিকভাবে কাতর হয়ে পড়েন এবং মদ্যপান আরম্ভ করেন। এই মদ্যপানই পরবর্তীকালে তার মৃত্যুর কারণ হয়।

শিক্ষা

সম্পাদনা

হরিশ্চন্দ্র ছোটবেলায় ভবানীপুরের একটি পাঠশালায় পড়াশোনা আরম্ভ করেন। ছোটবেলাতেই তার অসাধারণ মেধা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পাঠশালায় পড়বার সময় দাদা হারাণচন্দ্রের সাহায্যে তিনি ইংরেজি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি আনুমানিক সাত বছর বয়েসে ভবানীপুর ইউনিয়ন স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলটি কলকাতা স্কুল সোসাইটির পরিচালনাধীন ছিল। ডেভিড হেয়ার এই স্কুল কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। এই স্কুলে ভর্তির সময় হরিশ্চন্দ্রের মেধা দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে বিনা বেতনে পড়বার সুযোগ করে দেন। হরিশ্চন্দ্র প্রায় ছয় সাত বছর ভবানীপুর ইউনিয়ন স্কুলে পড়েন।

কর্মজীবন

সম্পাদনা

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই হরিশ্চন্দ্র লোকের নানা ধরনের দরখাস্ত লিখে বা দলিলপত্র নকল করে কিছু অর্থ উপার্জন করতেন। অসহায় অভিভাবকদের টাকা দিয়ে সাহায্য করবার জন্য তিনি ১৪-১৫ বছর বয়েস থেকেই কাজের চেষ্টা করতে আরম্ভ করেছিলেন। কিছুদিন চেষ্টা করে বর্তমান কলকাতার বিনয় বাদল দিনেশ বাগ অঞ্চলের (পূর্বতন ডালহৌসি স্কোয়ার) একটি নিলামদার কম্পানির অফিসে মাসিক দশ টাকা বেতনে বিল লেখকের চাকরি পান। একটি নির্দিষ্ট মাসিক আয়ের ব্যবস্থা হওয়াতে হরিশ্চন্দ্র তখন থেকে নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করায় মন দেন।

এই কম্পানির অফিসে সম্ভবত তিনি ছয়-সাত বছর কাজ করেছিলেন। কিন্তু এই স্বল্প বেতনে তার সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তাই তিনি বিকল্প চাকরির সন্ধান করতে থাকেন। হরিশ্চন্দ্রের পরিচিত জেমস ম্যাকেঞ্জির প্রচেষ্টায় মিলিটারি অডিটর জেনারেল অফিসে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তিনি মাসিক ২৫ টাকা বেতনে নকলনবিশ বা কপি রাইটার পদের জন্য মনোনীত হন। ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি এই পদে যোগ দেন। কর্মদক্ষতার কারণে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই হরিশ্চন্দ্র নকলনবিশ থেকে ১৩০ টাকা বেতনে কেরানীর পদে উত্তীর্ণ হন। কিছুদিন পরে এই বেতন বেড়ে ২০০ টাকা হয়। এই সময় এই অফিসে ১০০ টাকার বেশি বেতনের পদগুলি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত ছিল। শেষঅবধি হরিশ্চন্দ্র মাসিক ৪০০ টাকা বেতনে সহকারী অডিটর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন

সম্পাদনা

রাজনৈতিক দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য রাজা রাধাকান্ত প্রমুখের নেতৃত্বাধীন ল্যান্ড হোল্ডারস সোসাইটি এবং রামগোপাল ঘোষ, প্যারিচাঁদ প্রভৃতি শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পরিচালনাধীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি মিলে গিয়ে ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর ন্যাশন্যাল অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। এরপর ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ অক্টোবর এই প্রতিষ্ঠানটির নাম বদল করে রাখা হয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই হরিশ্চন্দ্র এই সভার সদস্য হননি। তিনি ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাস অর্থাৎ তার মৃত্যু অবধি এই প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘকাল তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক সহকারী সম্পাদক ছিলেন।

হরিশ্চন্দ্রের সাথে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটির জন্যই মাত্র আট বছরের মধ্যে হরিশ্চন্দ্রের খ্যাতি প্রায় সারা ভারতে ছড়িয়েছিল এমনকি ইউরোপের শিক্ষিত সমাজেও তার নাম প্রচারিত হয়েছিল। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা প্রথম ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়। এটি ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকার প্রবর্তক এবং প্রথম স্বত্বাধিকারী মধুসূদন রায়ের চিঠি থেকে জানা যায় যে হরিশ্চন্দ্র ছিলেন এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। আড়াই বছর ধরে হরিশ্চন্দ্র বিনা পারিশ্রমিকে প্রায় একাই হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা পরিচালনা করেন। এরপর তিনি এই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী মধুসূদন রায়ের কাছ থেকে হিন্দু পেট্রিয়ট প্রেস এবং কাগজের স্বত্ব কিনে নেন। হরিশ্চন্দ্র সেই সময় সরকারি কর্মচারী হওয়ায় নিজের নামে এই পত্রিকা কিনতে পারেননি। তিনি তার দাদা হারাণচন্দ্রের নামে এই স্বত্ব কেনেন। হরিশ্চন্দ্র এই কাগজে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ মারফত বৈদেশিক সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। এবং তিনি পত্রিকাটিকে একটি আধুনিক পত্রিকায় পরিণত করেন। তবুও ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষ অবধি এই পত্রিকা চালাতে হরিশ্চন্দ্রকে আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রথম থেকেই হরিশ্চন্দ্র সমাজের নিম্নতম শ্রেণির মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই শুরু করেন। তিনি সাধারণ মানুষের উপরে পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হন। বাংলার চাষীদের উপরে নীলকরদের অত্যাচার বন্ধের জন্য তিনি বাংলার উচ্চশ্রেণির মানুষদের এগিয়ে আসতে বলেন। তিনি তৎকালীন সরকারের আমদানি-রপ্তানি নীতিরও তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ভারত থেকে চাল, চিনি, তৈলবীজের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রপ্তানী করে মদ প্রভৃতি বিলাসদ্রব্য আমদানীর বিরোধিতা করেন। হরিশ্চন্দ্র বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বহুবিবাহ নিরোধ নিয়েও বহু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রস্তাব পুস্তকাকারে প্রকাশের সাথে সাথে এ বিষয়ে জনমত গঠনে সহায়তা করেন। হরিশ্চন্দ্র হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক রূপে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে বহু সংবাদ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি পত্রিকাতে পতিতা সমস্যা এবং সরকারী শিক্ষানীতি নিয়েও আলোচনা করেন।

তিনি সংস্কৃত ভাষার প্রসার এবং মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা করেন। হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদকীয়তে প্রাচীন বাংলার সাহিত্যের উল্লেখ ও উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে বাংলা ভাষার প্রতি হরিশ্চন্দ্রের অনুরাগ ছিল। সেই সময় যে সব বাংলা বই প্রকাশিত হত তার সমালোচনা হিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশিত হত।

হরিশ্চন্দ্রের সম্পাদনায় আন্তর্জাতিক খবরও হিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশিত হত। এতে ব্যবসা বাণিজ্য বাজারদর প্রভৃতিও থাকত। সেই সময় দেশীয় পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন খুব কম প্রকাশিত হত। কিন্তু হিন্দু পেট্রিয়টে দেশি বিদেশি ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন। হিন্দু পেট্রিয়ট ধীরে ধীরে বিদেশি পরিচালিত পত্রিকাগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল।

১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমবর্ধমান সরকারি খাজনার চাপ, জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের শোষণের ফলে তারা খুব অসুবিধার মধ্যে পড়েছিল। সাঁওতালরা সংঘবদ্ধ ও সশস্ত্র হয়ে বহু দারোগা ও মহাজনদের হত্যা করেছিল। তাদের দমন করতে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী আসে এবং সাঁওতালদের হাতে বহু ব্রিটিশ সেনা প্রান হারায়। এই বিদ্রোহের নেতা সিধুকানুকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল। পনেরো থেকে পঁচিশ হাজার সাঁওতাল এই বিদ্রোহে মারা যায়। এই সাঁওতাল বিদ্রোহের খবর কলকাতায় পৌছোনোর পর ইউরোপীয় সংবাদপত্রগুলি সরকারকে কঠোরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করার পক্ষে রায় দিয়েছিল। কিন্তু হরিশ্চন্দ্র এই মত দেন যে কঠোর শোষণের ফলেই সাঁওতালরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি উপদ্রুত অঞ্চলে সামরিক শাসন জারিরও তীব্র বিরোধিতা করেন। হিন্দু পেট্রিয়ট ছাড়া সেসময় কোনো সংবাদপত্রই সাঁওতাল বিদ্রোহীদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায়নি। কিন্তু একমাত্র হরিশ্চন্দ্র তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং সরকারের কড়া সমালোচনা করে সাহসের পরিচয় দেন।

হরিশ্চন্দ্র লর্ড ডালহৌসির রাজ্যগ্রাসনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির সমালোচনা করার এই দুঃসাহস সরকারি ও বেসরকারি মহলকে চমকে দিয়েছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে লর্ড ডালহৌসি হরিশ্চন্দ্রের মুখ বন্ধ করবার জন্য তাকে লোভনীয় সরকারি চাকরির উৎকোচ দিতে চান। কিন্তু হরিশ্চন্দ্র এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম কর্মকর্তা হিসাবে অনেকে হরিশ্চন্দ্রকে জমিদারি স্বার্থের পৃষ্ঠপোষক রূপে চিহ্নিত করেন। কিন্তু হিন্দু পেট্রিয়টে জমিদারি শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধেও অনেক খবর প্রকাশিত হত।

হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদনার ভার পেয়েই হরিশ্চন্দ্র বাংলার কৃষকদের অবস্থা পর্যালোচনা করেন। শুধুমাত্র অত্যাচারী জমিদাররাই যে কৃষকদের একমাত্র শত্রু নয় তা তিন লক্ষ্য করেন। তিনি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলেন বাংলার চাষীদের সবচেয়ে বড় শত্রু নীল ব্যবসা এবং নীলকর। হিন্দু পেট্রিয়টের শুরু থেকেই তিনি নীলচাষীদের স্বার্থরক্ষায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। ১৮৫৪ থেকে হরিশ্চন্দ্র নীলকরদের বিরুদ্ধে চাষীদের পক্ষ নিয়ে লেখা শুরু করেন। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ থেকে তিনি নিয়মিতভাবে নীলকরদের বিরুদ্ধে লিখতে থাকেন। তিনি বাংলার নানা জায়গায় এই সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য সংবাদদাতা নিয়োগ করেন। তিনি নীলচাষ প্রথা এবং নীলকরদের সম্পর্কে জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। তাদের অত্যাচারের বহু বিবরণও হিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশিত হয়েছিল। নিজস্ব সংবাদদাতা ছাড়াও বেশ কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি এবং শ্বেতাঙ্গ পাদ্রীও নীলকরদের অত্যাচারের খবর হিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশের জন্য পাঠাতেন। হিন্দু পেট্রিয়ট অনেক শিক্ষিত ইংরেজই পড়তেন। এই পত্রিকার পাঠক ইংল্যান্ডেও ছিল। ফলে ইংরেজদের মধ্যেও নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়।

গ্রাম বাংলার বহু নিপীড়িত নীলচাষীরা কলকাতার ভবানীপুরে হরিশ্চন্দ্রের বাড়িতে এসে ধরনা দিত। অপরিচিত কলকাতা শহরে এদের আহার এবং থাকার কোন ব্যবস্থা না থাকায় এরা হরিশ্চন্দ্রের বাড়িতেই আহার এবং আশ্রয় পেত। হরিশ্চন্দ্রের বহু অর্থ এই মানুষদের আহার এবং আশ্রয় দিতে খরচ হয়ে যেত। হরিশ্চন্দ্র প্রতিটি চাষীর ব্যক্তিগত সমস্যা শুনে তাকে উপযুক্ত পরামর্শ দিতেন। অনেকসময়ে নিজেই তার দরখাস্ত লিখে দিতেন এবং যেখানে আদালতে যাওয়া দরকার সেখানে স্থানীয় কোন মোক্তারকে চিঠি লিখে দিতেন। এই মোক্তারদের পারিশ্রমিকও অনেকসময় হরিশ্চন্দ্র দিতেন।

হরিশ্চন্দ্র চিরকাল অমানুষিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত ছিলেন। রাতে কয়েক ঘণ্টা ছাড়া সারাদিন তিনি কর্মব্যস্ত থাকতেন। নীলবিদ্রোহের সূচনাকাল থেকে তার এই ঘুমের সময়েও টানাটানি পড়ে। সারাদিন অফিসের কাজ সেরে তারপর বাড়িতে গ্রামের প্রজাদের অভাব অভিযোগ শুনতে হত এবং তাদের পরামর্শ এবং অন্যান্য সাহায্য করতে হত। এরপর গভীর রাত্রিতে তাকে জেগে হিন্দু পেট্রিয়টের কাজ করতে হত। সাদ রায় তাকে জোর করে উত্তর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে তার বাড়িতে নিয়ে যান। এখানে কলকাতা শহরের সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক ডা. এডোয়ার্ড গুডিভ এবং ডা. নীলমাধব মুখোপাধ্যায় তার চিকিৎসা করেন। তার রোগ ক্ষয়কাশ বা যক্ষ্মা বলে ধরা পড়ে। হরিশ্চন্দ্র বুঝতে পারেন যে তার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। তিনি তখন ভবানীপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। এত অসু্স্থ অবস্থাতেও তিনি হিন্দু পেট্রিয়টের কাজ থেকে ছুটি নেন নি। যত দিন পেরেছেন তিনি হিন্দু পেট্রিয়টের জন্য সম্পাদকীয় লিখে গেছেন। অবশেষে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুন শুক্রবার সকাল সাড়ে নটার সময়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে হরিশ্চন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর তিন মিনিট আগে হরিশ্চন্দ্র জ্বরের ঘোরে চিৎকার করে ওঠেন - ওরে পেট্রিয়ট মেশিনে ওঠাসনে, প্রুফটা আর-এক বার আমাকে দিয়ে দেখিয়ে তবে ছাপিস। এটাই হরিশ্চন্দ্রের মুখের শেষ কথা। হিন্দু পেট্রিয়টের চিন্তা তার জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তার মনে ছিল।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা

বহি:সংযোগ

সম্পাদনা
  • হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হিন্দু পেট্রিয়ট - গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত - পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
  • সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান - প্রথম খণ্ড সংশোধিত চতুর্থ সংস্করণ - সাহিত্য সংসদ