শ্যাম বেনেগল
শ্যাম বেনেগল (জন্ম ১৪ ডিসেম্বর ১৯৩৪) হলেন একজন ভারতীয় পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। তার প্রথম চারটি চলচ্চিত্র - অঙ্কুর (১৯৭৩), নিশান্ত (১৯৭৫), মন্থন (১৯৭৬), ও ভূমিকা (১৯৭৭) দিয়ে তিনি একটি নতুন ধরনের অংশ হন, যা বর্তমানে ভারতের "মধ্য চলচ্চিত্র" বলে অভিহিত। তিনি এই পরিভাষাটি অপছন্দ করেন এবং তার কাজগুলিকে নব বা ভিন্নধারার চলচ্চিত্র বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার চলচ্চিত্রগুলিতে প্রধানত নারী এবং নারীর অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে জোর দেওয়া হয়ে থাকে।[১] তিনি ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সংসদ সদস্য ছিলেন।
শ্যাম বেনেগল | |
---|---|
জন্ম | শ্যামসুন্দর বেনেগল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৩৪ |
শিক্ষা | স্নাতকোত্তর (অর্থনীতি) |
মাতৃশিক্ষায়তন | ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | পরিচালক, চিত্রনাট্যকার |
দাম্পত্য সঙ্গী | নীরা বেনেগল |
আত্মীয় | গুরু দত্ত |
রাজ্যসভা সংসদ সদস্য | |
কাজের মেয়াদ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ – ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ |
১৯৭৬ সালে বেনেগল ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী লাভ করেন এবং ১৯৯১ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ লাভ করেন।[২] ২০০৭ সালে বেনেগল ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের আজীবনন সম্মাননা অর্জন করেন। তিনি সাতবার শ্রেষ্ঠ হিন্দি ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ২০১৮ সালে মুম্বই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ভি. শান্তরাম আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন।
প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনাশ্যাম বেনেগল ১৯৩৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ত্রিমুলঘেরিতে (বর্তমান তেলেঙ্গানা, ভারত) এক ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্টে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মনাম ছিল শ্যামসুন্দর বেনেগল। তার পিতা শ্রীধর বি. বেনেগল ছিলেন একজন আলোকচিত্রী। শ্যামের বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তার পিতার দেওয়া একটি ক্যামেরা দিয়ে।[১] তিনি হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি হায়দ্রাবাদ ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা গুরু দত্তের মাতামহী শ্যামের পিতামহীর বোন ছিলেন।
কর্মজীবন
সম্পাদনাপ্রারম্ভিক কর্মজীবন
সম্পাদনা১৯৫৯ সালে তিনি লিন্টাস অ্যাডভার্টাইজিং নামে একটি মুম্বই-ভিত্তিক বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপিরাইটার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি ধীরে ধীরে প্রধান সৃজনশীল কর্মকর্তায় উত্তীর্ণ হন। ইতোমধ্যে তিনি গুজরাতি ভাষায় তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ঘর বেঠা গঙ্গা (১৯৬২) নির্মাণ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি এএসপি নামে আরেকটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় অল্প কিছুদিন কাজ করেন। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কর্মরত থাকাকালীন তিনি নয় শতাধিক প্রামাণ্যচিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্র পরিচালনা করেন। তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য তাকে আরও এক দশক অপেক্ষা করতে হয়, তিনি এই সময়ে পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করছিলেন।[১]
১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩ সালে বেনেগল পুনের ভারতীয় চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন সংস্থানে শিক্ষকতা করেন এবং ১৯৮০-৮৩ ও ১৯৮৯-৯২ সালে দুইবার এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করেন। এই সময়ে তার নির্মিত আ চাইল্ড অব দ্য স্ট্রিটস (১৯৬৭) ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। সর্বোপরি তিনি ৭০টি প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই সময়ে তার নির্মিত কয়েকটি কাজ হল গুজরাতের ন্যাশনাল ডায়েরি ডেভলপমেন্ট বোর্ডের জন্য মন্থন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিপিআই-এম পরিচালিত আরোহণ, হ্যান্ডলুম কো-অপারেটিভসের সুসমান, ভারতীয় রেলওয়ের যাত্রা, ভারতীয় ও সোভিয়েত সরকারের উপর নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র নেহরু এবং ভারত এক খোঁজ।[১] ১৯৮৬ সালে দূরদর্শনে প্রচারিত ১৫ খণ্ডের যাত্রা সম্পূর্ণই সে সময়ে ভারতের দীর্ঘতম পথ অতিক্রমকারী রেলগাড়ি হিমসাগর এক্সপ্রেসে চিত্রায়িত হয়।[৩] জওহরলাল নেহরুর বই ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে নির্মিত ৫৩ পর্বের টেলিভিশন ধারাবাহিক ভারত এক খোঁজ[৪] ভারতের প্রারম্ভ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস বিবৃত করে।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
সম্পাদনা- অঙ্কুর (১৯৭৪): হায়দরাবাদের এক সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। অভিনয়ে : অনন্ত নাগ ও শাবানা আজমি।
- নিশান্ত (১৯৭৫): ভারতের গ্রামাঞ্চলের সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার, ফ্যাসিবাদ এবং যৌন শোষণ চিত্রায়িত হয়েছে এই চলচ্চিত্রর। অভিনয়ে: গিরিশ কর্নদ, শাবানা আজমি, অমরিশ পুরি, নাসিরুদ্দিন শাহ, অনন্ত নাগ এবং স্মিতা পাতিল।
- মন্থন (১৯৭৬): ভারতের ‘শ্বেত বিপ্লব’-এর প্রেক্ষাপটে তৈরি। অভিনয়ে: স্মিতা পাতিল, গিরিশ কর্নদ, নাসিরুদ্দিন শাহ, অমরিশ পুরি।
- ভূমিকা (১৯৭৭): মারাঠি অভিনেত্রী হাঁসা ওয়াদকরের জীবন নিয়ে নির্মিত। মূল চরিত্রে স্মিতা পাতিল।
- ত্রিকাল (১৯৮৫): খ্রিষ্টান এক পরিবারের পর্তুগিজ শাসিত গোয়ায় বসবাসের গল্প। অভিনয়ে: লীলা নাইদু, নাসিরুদ্দিন শাহ, নিনা গুপ্তা।
- জুনুন (১৯৭৮): ভারতীয় পুরুষ এবং ব্রিটিশ নারীর প্রেমের গল্প। অভিনয়ে: শাবানা আজমি, নাফিসা আলি, জেনিফার কেন্ডল, নাসিরুদ্দিন শাহ।
- মান্ডি (১৯৮৩): হায়দরাবাদের এক যৌনপল্লির ঘটনা। অভিনয়ে: শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, নাসিরুদ্দিন শাহ।
- সুসমান (১৯৮৭): অন্ধ্র প্রদেশের গ্রামাঞ্চলের তাঁতিদের জীবনের নানা সংগ্রামের চিত্রায়ণ। অভিনয়ে: শাবানা আজমি, ওম পুরি, কুলভূষণ খরবান্দা, নীনা গুপ্ত।
- কলিযুগ (১৯৮১): একটি ষড়যন্ত্র এবং দুটি পরিবারের লড়াইয়ের গল্প। অভিনয়ে: শশী কাপুর, রেখা, রাজ বব্বর, সুপ্রিয়া পাঠক, অনন্ত নাগ, কুলভূষণ খরবান্দা।
- সুরজ কা সত্বন ঘোড়া (১৯৯২): একজন পুরুষের জীবনে বিভিন্ন সময়ে আসা তিনজন নারীর গল্প নিয়ে নির্মিত। অভিনয়ে: রজিত কাপুর, নিনা গুপ্তা, রাজেশ্বরি সাচদেব, অমরিশ পুরি।[৫]
- নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: দ্য ফরগোটেন হিরো (২০০৫): নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের জীবনের শেষ পাঁচ বছরের ঘটনা নিয়ে নির্মিত। অভিনয়ে: শচীন খেদেকর, কুলভূষণ খারবান্দা, রজিত কাপুর, আরিফ জাকারিয়া ও দিব্যা দত্ত।[৬]
- মুজিব-একটি জাতির রূপকার (২০২৩): বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন কাহিনী নিয়ে নির্মিত। অভিনয়ে: আরিফিন শুভ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ফজলুর রহমান বাবু, চঞ্চল চৌধুরী, নুসরাত ফারিয়া, রিয়াজ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শহীদুল আলম সাচ্চু, তৌকির আহমেদ, গাজী রাকায়েত, তুষার খান, শতাব্দী ওয়াদুদ, মিশা সওদাগর ও প্রার্থনা ফারদিন দীঘি।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ "Movies: An interview with Shyam Benegal"। রেডিফ.কম। ২৮ জুলাই ১৯৯৯। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০২০।
- ↑ "Padma Awards" (পিডিএফ)। Ministry of Home Affairs, Government of India। ২০১৫। ১৫ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
- ↑ পাল, চন্দ্রিমা (১৪ ডিসেম্বর ২০১৫)। "The DD Files: Shyam Benegal's 'Yatra' packed all of India in a train"। স্ক্রল.ইন (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০২০।
- ↑ "What makes Shyam special..."। দ্য হিন্দু (ইংরেজি ভাষায়)। ১৭ জানুয়ারি ২০০৩। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০২০।
- ↑ শ্যাম বেনেগালের দশ সিনেমা, একবার হলেও দেখা উচিত, চ্যানেল আই অনলাইন ডটকম, ২৩ জানুয়ারি ২০২১
- ↑ ইংরেজি ভাষায় Netaji Subhas Chandra Bose: The Forgotten Hero, IMDb
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে শ্যাম বেনেগল (ইংরেজি)