কাগজ উৎপাদনের মূল তত্ত্ব হল, আঁশ জাতীয় পদার্থের লঘু জলীয় মিশ্রণকে একটি স্বচ্ছিদ্র পর্দার উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে মিশ্রণের জলীয় অংশ পর্দা ভেদ করে ঝড়ে যায় আর পর্দার উপরে আঁশের পাতলা একটা আস্তরণ পড়ে থাকে। এই আস্তরণ কে ধিরে ধিরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে কাগজে পরিণত করা হয়। অধিকাংশ কাগজ কাঠ থেকে উৎপাদিত মন্ড হতে প্রস্তুত করা হয়। এছাড়া তুলা এবং কাপড় থেকেও কাগজ প্রস্তুত হয়ে থাকে। কাগজ তৈরির বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন:

এক পাতা সাদা কাগজ।

রাসায়নিক পদ্ধতিতে মণ্ড তৈরি

সম্পাদনা

রাসায়নিক মণ্ড তৈরি পদ্ধতিতে ছোট ছোট কাঠের টুকরার সাথে নানারকম রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে একটি বড় পাত্রে নেয়া হয় এবং প্রচণ্ড তাপ দেয়ার ফলে রাসায়নিক পদার্থ গুলো ও কাঠের গুড়ি গুলো ভেঙে একটি মিশ্রণ তৈরি হয় যা কাঠের তন্তুগুলোকে জমিয়ে ফেলে তন্তু গুলোর কোনোরকম পরিবর্তন না করে। রাসায়নিক মণ্ড যে কোনো শক্ত দ্রব্য প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয় কিংবা এই মণ্ড কোনো উপাদানের সাথে মিশ্রণে ভিন্নরকম বা নতুন কোন গুনাবলী বা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দ্রব্য তৈরী করতে ব্যবহৃত হয়। কাগজ প্রস্তুত করার প্রধান বা সব থেকে জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে ক্রাফট পদ্ধতি এরপর দ্বিতীয় প্রধান পদ্ধতির নাম সালফাইট পদ্ধতি। ঐতিহাসিকভাবে সোডা দ্বারা মণ্ড প্রস্তুত পদ্ধতি প্রথম সফল রাসায়নিক মণ্ড প্রস্তুত পদ্ধতি।

রাসায়নিক পদ্ধতিতে মণ্ড প্রস্তুতের মূল উদ্দেশ্য, লিজনিন (lignin) এর রাসায়নিক গঠন ভেঙে ফেলে কোষ বা তন্তু থেকে আলাদা করে সরিয়ে দেয়া। কারণ লিজনিন উদ্ভিদের কোষগুলোকে দৃঢ় ভাবে আটকে রাখে। রাসায়নিক পদ্ধতিতে এই তন্তু গুলোকে মুক্ত করে দেয় এবং মণ্ড প্রস্তুত করে। এই মণ্ড দিয়ে লেখার, ছাপানোর জন্য বা অন্যান্য কাজের জন্য সাদা কাগজ প্রস্তুত করা যায়। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত মণ্ডের থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত মণ্ডের ব্যয় অধিক। এর মূল কারণ ৪০%-৫০% আসল কাঠ দিয়ে বানালেও তা দিয়ে যে টুকু মণ্ড প্রস্তুত করা যায় তার পরিমাণ খুব কম। তথাপি রাসায়নিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত মণ্ড দিয়ে সর্বাধিক শক্ত কাগজ তৈরি করা সম্ভব কারণ এই পদ্ধতিতে উদ্ভিদের তন্তুর দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকে। এই পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে কাজ করতে যে তাপ ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় তার বেশিরভাগ মণ্ড তৈরির সময় লিজনিন পুড়ে পাওয়া যায়। কাগজের মণ্ড উৎপাদনের সব থেকে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতির নাম ক্রাফট পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত মণ্ড হয় সর্বাধিক শক্ত কাগজ যা সরাসরি ব্যাগ বা বাক্স বানাতে ব্যবহার করতে পারে কিন্তু এমনটি না করে কার্ডবোর্ড বানানোর জন্য আরো কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়।

যান্ত্রিক পদ্ধতি

সম্পাদনা

যন্ত্রিক পদ্ধতিতে মণ্ড প্রস্তুত করার প্রধান দুই ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। পদ্ধতি দুটি হলো:

  • তাপসম্বন্ধীয় যান্ত্রিক পদ্ধতিঃ তাপসম্বন্ধীয় যান্ত্রিক মণ্ড পদ্ধতিতে, কাঠে ছোট ছোট খন্ড করা হয়। এরপর এই কাঠের খন্ডগুলো বিশাল বাস্পচালিত তাপীয় পরিশোধক যন্ত্রের মাঝে সরবরাহ করা হয়। এই যন্ত্র কন্ডগুলোকে প্রচন্ড চাপে পেষন করে এবং দুইটি স্টিলের চাকতির মাঝ দিয়ে টেনে নিয়ে আঁশ বা তন্তু তৈরি করে।
  • গ্রাউন্ড উড পদ্ধতিঃ গ্রাউন্ড উড পদ্ধতিতে, বাকল বা ছাল ছাড়ানো কাঠের গুড়ি একটি চূর্ণন যন্ত্রে সরবরাহ করা হয় যেখানে চক্রাকারে আবর্তিত পাথরের মধ্যে কাঠের গুড়িগুলোকে প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং কাগজের মণ্ড প্রস্তুত হয়।

যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহারে কাঠের লিজনিন নষ্ট হয়না তাই এই পদ্ধতিতে অনেক বেশি পরিমানে উৎপাদিত দ্রব্য পাওয়া যায় (প্রায় ৯৫%)। কিন্তু এই মণ্ড দিয়ে প্রস্তুতকৃত কাগজ হলুদ রঙের ও ভঙ্গুর হয়। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত আঁশ হয় ছোট হয় নয়ত এই মণ্ড দিয়ে তৈরি কাগজ নরম হয়। যদিও এই পদ্ধতিতে বৃহৎ পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় তবুও এর ব্যয় রাসায়নিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত কাগজের ব্যয় থেকে বেশি।

কালি অপসারণ পদ্ধতি

সম্পাদনা
রিসাইকেলিং পদ্ধতি

পুর্নব্যবহারোপযোগী করার প্রক্রিয়ায়, রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরি মণ্ড ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত মণ্ড উভয়ই ব্যবহার করা যায়। পানি মিশ্রণ করে যন্ত্রের মাধ্যমে কাগজের তন্তু বা আঁশ গুলোর হাইড্রোজেন বন্ধন মুক্ত করে তাদের আলাদা করা হয়। অধিকাংশ পুর্নব্যবহারকৃত কাগজ একটি বৃহৎ সংখ্যক অব্যবহৃত আঁশ ধারণ করে থাকে। সাধারনত কালি অপসারিত মণ্ড হচ্ছে একই মানসম্পন্ন ও কিছুটা নিম্নমানের ব্যবহারকৃত কাগজ দিয়ে প্রস্তুত করা। পুর্নব্যবহারোপযোগী প্রক্রিয়ার তিনটি প্রধান পদ্ধতি রয়েছে।

  • কারখানার অব্যবহৃত কাগজঃ অধিকাংশ পেপারমিল গুলোতে উৎপাদিত কাগজের কিছু সংখ্যক কাগজ বিক্রয় না করে সমস্যা থাকার কারণে আবার নতুন করে প্রস্তুতের জন্য দেয়া হয়। কিছু কাগজ অনেক বছর পুরোনো পরে থাকা যখন এই প্রক্রিয়ার ব্যবহার ছিল না।
  • বিক্রয়ের পর নষ্ট হয়া কাগজঃ অনেক সময় ক্রেতা কর্তৃক কাগজ নষ্ট হয়। সাধারনত প্রিন্ট ভুল হলে প্রিন্ট ঠিক মত না হলে সেই কাগজ সবাই ফেলে দেয়। এই ধরনের কাগজের কালি অপসারন করে আবার পুর্নব্যবহারোপযোগী করার প্রক্রিয়ায় নতুন করে উৎপাদন করা হয়।
  • ব্যবহারকৃত কাগজঃ প্রিন্ট করার পর সব কাগজ মানুষ ব্যবহারের পর একসময় ফেলে দেয়। সেই সব কাগজ কালি অপসারন করে নতুন করে মণ্ড প্রস্তুত করা হয়

হাতে তৈরি কাগজ

সম্পাদনা
মিডিভেল উৎসবে একজন হাতে কাগজ তৈরি করছে।

এ পদ্ধতিতে কাগজ উৎপাদনের জন্য প্রথমে কাগজের মন্ড কে একটি বড় পাত্রে পানির সাথে ভালো করে মেশানো হয়। অতঃপর এই মিশ্রণ কে একটি ছাঁচে ঢালা হয়। এই ছাঁচটি তারের জাল এবং কাঠের ফ্রেম দিয়ে তৈরি। মিশ্রণটিকে ছাঁচে ঢাললে তারের জাল চুঁইয়ে পানি ঝরে যায়, আর আঁশের একটি পাতলা আস্তরণ জালের উপরে থেকে যায়। এই আস্তরণ টি ভেজা থাকে। একে শুকানোর জন্য এর উপরে পশমের কম্বল জাতীয় কাপড় দিয়ে চাপ দেওয়া হয়। এর ফলে আস্তনণটির জলীয় অংশ কম্বল শুষে নেয় এবং এতে কিছুটা দৃঢ়তা দান করে। এরপর এই আস্তরণটিকে ছাঁচ থেকে তুলে ঝুলিয়ে রেখে বা বিছিয়ে রেখে বায়ুতে শুকানো হয়। আর এর মাধ্যমেই তৈরি হয় হাতে তৈরি কাগজ।

শুকানোর পরে সাধারণত কাগজটিকে ২টি রোলারের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করানো হয়। এর মাধ্যমে কাগজের দৃঢ়তা আরও বাড়ানো হয়। কাগজটি কি কাজে ব্যবহৃত হবে, সে অনুসারে তার দৃঢ়তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। লেখা এবং ছাপার কাজে অপেক্ষাকৃত দৃঢ় কাগজ আর জলরঙে ছবি আঁকার কাজে ব্যবহৃত হয় অপেক্ষাকৃত নরম কাগজ। হাতে তৈরি কাগজের ছাঁচটিকে ডেকেল বলে। এটি ব্যবহারের কারণে কাগজের প্রান্তগুলো অনিয়মিত এবং ঢেউ আকৃতির হয়। একে “ডেকেল এজ” বা “ডেকেল প্রান্ত” বলে। এই ধরেনের কাগজের প্রান্ত দেখে নির্ধারণ করা যায় কাগজ টি হাতে নাকি যন্ত্রে তৈরি । আজকাল এ ধরনের কাগজ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার এ ধরনের কাগজে তারের জালের লম্বা লম্বা সরু দাগ থেকে যায়। যার মাধ্যমে কাগজে জল ছাপ দেওয়া সম্ভব। পরীক্ষাগারে কাগজ উৎপাদন পদ্ধতি পাঠদানের জন্য এবং কাগজ কলে মান নিয়ন্ত্রণের জন্য হাতে তৈরি কাগজ প্রস্তুত করা হয়।

কাগজ কলের প্রচলন

সম্পাদনা

আব্বাসীয় খিলাফত আমালে আনুমানিক ১২শ শতাব্দীতে বাগদাদে পৃথিবীর প্রথম কাগজ কলের প্রচলন ঘটায়। দশ বছরের মধ্য আব্বাসীয়রা স্পেনে উমাইয়া রাজধানী কর্ডোবাতে আরেকটি নামকরা কাগজ কল নির্মাণ করে।[]

আরোও পড়ুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Wade, Geoffrey (২০১২), Wade, Geoff; Tana, Li, সম্পাদকগণ, Anthony Reid and the Study of the Southeast Asian Past, Singapore: Institute of Southeast Asian Studies, পৃষ্ঠা 138 n. 4, Tazi in Persian sources referred to a people in that land, but was later extended to cover Arab lands. The Persian term was adopted by Tang China (Dàshí :大食) to refer to the Arabs until the 12th century .

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা