আলাওল
আলাওল, পূর্ণনাম সৈয়দ আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) হলেন মধ্যযুগের একজন বাঙালি কবি।[১][২] তিনি তার কাব্যগ্রন্থ পদ্মাবতীর জন্য বিখ্যাত, যা হলো এক সিংহলদেশীয় রাজকন্যা পদ্মাবতীর উপাখ্যান। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবিদের মধ্যে বিশেষত, মুসলমান কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়।[২] আলাওল আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি হিসাবে আবির্ভূত হলেও মধ্যযুগের সমগ্র বাঙালি কবির মধ্যে 'শিরোমণি আলাওল' রূপে শীর্ষস্থান অধিকারী। তিনি আরবি, ফার্সি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল। প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্রীয় ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দেন।[৩][৪]
আলাওল | |
---|---|
সৈয়দ আলাওল | |
জন্ম | ১৬০৭ |
মৃত্যু | ১৬৮০ (বয়স ৭২–৭৩) |
পেশা | কবি |
পরিচিতির কারণ | পদ্মাবতী কাব্য |
জীবনী
সম্পাদনাকবি সৈয়দ আলাওল আনুমানিক ১৬০৭ সালে তৎকালীন[৫] মাদারীপুর জেলার ফতেয়াবাদে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে মাদারীপুরের জালালপুরে অবস্থিত। তার পিতা ছিলেন ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিশ এ কুতুবের অমাত্য। তিনি বাংলা, আরবি, ফার্সি এবং সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের মতে কবির জন্ম ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে এবং মৃত্যু বৃদ্ধ বয়সে, ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। জলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় আলাওল ও তার পিতা পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন ও তার পিতা জলদস্যুদের হাতে নিহত হন। অতঃপর তিনি জলদস্যুদের হাতে পরে ক্রীতদাস হিসাবে আরাকানে নীত হন। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে আরাকানে। তিনি আরাকান রাজ সাদ উমাদার-এর অশ্বারোহী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেলে একসময় তিনি হয়ে পড়েন রাজসভার কবি। তাকে কাব্যচর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন রাজার একজন প্রধান কর্মচারী মাগন ঠাকুর।[৬]
কাব্য
সম্পাদনাআলাওলের প্রধান কাব্য পদ্মাবতী, যা ছিল কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দি কাব্য পদুমাবৎ-এর অনুবাদ। এ কাব্য তিনি প্রায় তিন বছর সময়ব্যয়ে ১৬২৭ সালে শেষ করেন এবং আরাকানপতির আত্মীয় সৈয়দ মুসা'র উৎসাহে তিনি সয়ফল মুলুক ও বদিউজ্জামাল নামক পারস্য গ্রন্থ অনুবাদ করেন[৩][৭]। মধ্যযুগের আরেক কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য শেষ করেন আলাওল, এর নাম সতীময়না[৭]। এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে : তোহ্ফা, দারাসেকেন্দারনামা প্রভৃতি। কবি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের একটি অন্তরা :
ত্রিভূবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে (হতে) বশ
যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর
মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর[৪]
মহাকবি আলাওল তার বিখ্যাত সপ্ত পয়কর কাব্যে রাসুল বন্দনার প্রসঙ্গে লিখেছেন:
চেতন স্বরুপ যদি হইল প্রচার।।
অতি ঘোরতর তমঃআকার বর্জিত।
মহা জ্যোতিমংয় হৈল আল্লার-ঈঙ্গিত।।
জ্যোতি সমুদ্রে আদ্যি নুর মহাম্মদ।
জগৎ বিজয়ী হৈতে পাইল সম্পদ।।
সপ্ত স্বর্গ উদ্যানের আদ্য নব ফুল।
বৃদ্ধি বাক্যে শিরোমণি ভূবনে অতুল।।
সেই পুস্প হৈতে আদ্যে আদম উজ্জল।
সকল কদর্মপূর্ণ সে-ই নির্মল।।[৮]।
কবি দৌলত কাজির অসমাপ্ত কাব্য সতীময়না গ্রন্থে মোহাম্মদের 'সিফত' বয়ান হয়েছে এভাবে:
মিম হন্তে পরতেক
যে মিমেত জগৎ মোহন[৮]।
সৃষ্টিকর্ম এবং কার নির্দেশে রচনা করেন:
সম্পাদনা- পদ্মাবতী (১৬৪৮ খ্রি.)- মাগন ঠাকুরের নির্দেশে
- সতীময়না লোরচন্দ্রানীর উত্তরাংশ (১৬৫৯ খ্রি.)- সুলেমানের নির্দেশে
- সপ্ত পয়কর (১৬৬০ খ্রি.)- সৈয়দ মহম্মদের নির্দেশে
- সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল (১৬৫৮-৭০ খ্রি.)- মাগন ঠাকুরের অনুরোধে শুরু করেন কিন্তু কাব্য শেষ হওয়ার পূর্বেই তিনি মারা গেলে পরে আরাকানের বিচারপতি কাজী সৈয়দ মসুদ শাহার নির্দেশে সম্পন্ন করেন।
- সিকান্দরনামা (১৬৭১-৭২ খ্রি.)- আরাকানরাজ মজলিস নবরাজের নির্দেশে
- তোহফা (১৬৬৩-৬৯ খ্রি.)- সুলেমানের নির্দেশে
- রাগতালনামা[২][৯]
লেগ্যাসি
সম্পাদনাবাংলাদেশে একটি সাহিত্য পুরস্কার আলাওলের নামে নামকরণ করা হয়েছে। প্রতি বছর বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিককে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পুরুষ শিক্ষার্থীদের ডরমিটরি ও ছাত্রাবাস তাঁর নামে আলাওল হল হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।[১০]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Datta, Amaresh (১৯৮৭)। Encyclopaedia of Indian Literature: A-Devo (ইংরেজি ভাষায়)। Sahitya Akademi। আইএসবিএন 978-81-260-1803-1।
- ↑ ক খ গ ওয়াকিল আহমদ (২০১২)। "আলাওল"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ ক খ মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য কবিতা, প্রকাশক-জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, মতিঝিল, ঢাকা, প্রকাশকাল-১৯৮৩ খ্রি., পৃ. ৪ - ৯
- ↑ ক খ সিলেটের মরমী মানস, প্রাক কথন সৈয়দ মোস্তফা কামাল, প্রকাশনায়- মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ, প্রকাশকাল ২০০৯।
- ↑ Rizvi, S.N.H., সম্পাদক (১৯৬৫)। East Pakistan District Gazetteers: Chittagong (পিডিএফ)। Government of East Pakistan Services and General Administration Department। পৃষ্ঠা 349। ৭ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ নভেম্বর ২০১৬।
- ↑ "আলাওল"। ইনকিলাব। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-২২।
- ↑ ক খ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়, পৃঃ ২৮৪, প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪।
- ↑ ক খ কাসিদায়ে ন'মান অনুবাদক- ডঃ মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, প্রাকাশক গাউছুল আ'যম ও আলা হযরত রিসার্চ একাডেমী, ঢাকা, প্রকাশকাল- ৩০ মে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ।
- ↑ "স্ম র ণ : মহাকবি আলাওল"। Daily Nayadiganta। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-২২।
- ↑ "Official Website". University of Chittagong. Retrieved: 2014-01-21